সব বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে বুধবারই ভারতের মাটিতে নামছে ৫টি রাফাল। প্রথম ধাপে আসছে পাঁচটি। তার পর ধাপে ধাপে মোট ৩৬টি যুদ্ধবিমান আসবে। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, রাফাল হাতে পাওয়ার পর ভারতীয় বায়ুসেনার ক্ষমতা ও শক্তি অনেকটাই বেড়ে যাবে।
দুই ইঞ্জিনের মিডিয়াম মাল্টি রোল কমব্যাট এয়ারক্র্যাফট গোত্রের এই যুদ্ধবিমানে রয়েছে এমন সব অত্যাধুনিক ক্ষমতা ও প্রযুক্তি যাতে শত্রুপক্ষকে সহজেই টেক্কা দেওয়া যায়। নিশানায় যেমন নিখুঁত ও দ্রুত, তেমনই একসঙ্গে অনেকগুলি কাজ করতে পারবে।
ফরাসি এই যুদ্ধবিমানের গতিবেগ ঘণ্টায় ২২২২ কিলোমিটার। ৫০ হাজার ফিট পর্যন্ত উপরে উঠতে পারে। তবে স্বচ্ছন্দে উড়তে পারে মাটি থেকে ৩৭ হাজার ফুট উপরে। মাঝ আকাশেই জ্বালানি ভর্তি করার ব্যবস্থাও রয়েছে। যে কোনও আবহাওয়ায় সমান স্বচ্ছন্দ রাফাল যুদ্ধবিমান।
যুদ্ধবিমানগুলির দৈর্ঘ্য ১৫.২৭ মিটার। প্রতিটি ডানার দৈর্ঘ্য ১০.৮ মিটার। সুখোইয়ের চেয়েও বেশি ওজন বহন করতে পারে রাফাল। সুখোইয়ের বহন ক্ষমতা ৮০০০ কিলোগ্রাম। রাফাল সেখানে ৯৫০০ কেজি ওজন নিয়ে উড়তে সক্ষম।
রাফালের রয়েছে ‘ডেল্টা উইং’। গ্রিক বর্ণ ‘ডেল্টা’ থেকে এই নামের উৎপত্তি, যার আকৄতি অনেকটা ত্রিভূজের মতো। অত্যাধুনিক অধিকাংশ যুদ্ধবিমানেই এই ডেল্টা উইং থাকে, যা দ্রুতগতিতে উড়তে সাহায্য করে।
ফরাসি সমরাস্ত্র প্রস্তুতকারী সংস্থা দাসো এভিয়েশনের তৈরি এই যুদ্ধবিমানে ইঞ্জিনের এমন ক্ষমতা যে, ‘কমব্যাট মোড’ থেকে স্থির অবস্থায় ফিরে আসতে সময় লাগে মাত্র ৩ সেকেন্ড।
রাফাল যুদ্ধবিমান পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম। শুধু তাই নয়, প্রায় সব ধরনের অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র বহন করে উড়তে পারে এবং নিখুঁত নিশানায় হামলা চালাতে পারে।
নেক্সট জেন প্রযুক্তির আকাশ থেকে আকাশ মাইকা, দূরপাল্লার আকাশ থেকে আকাশ মেটিওর, দূরপাল্লার স্কাল্প, যুদ্ধজাহাজ বিধ্বংসী এএম ৩৯ এক্সোসেট-এর মতো ক্ষেপণাস্ত্র বহন করে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে রাফাল যুদ্ধবিমান। স্কাল্প ক্ষেপণাস্ত্র স্থির লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করতে পারে। আর মাইকা ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের অদৄশ্য বস্তুতেও হামলা চালানো যায়।
ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়াও বিভিন্ন প্রকৄতির লেজার নির্দেশিত বোমা, অনির্দেশিত ক্লাসিক বোমাও ফেলা যায় এই যুদ্ধবিমান থেকে। রাফাল থেকে ছোড়া যায় নেক্সটর ৩০এম৭৯১৩০ ইন্টারনাল কামান। এই কামান প্রতি মিনিটে ২৫০০ রাউন্ড গোলাবর্ষণ করতে পারে।
শুধু আক্রমণ শানানো নয়, যে কোনও যুদ্ধে শত্রুপক্ষের থেকে কৌশলগত দিক থেকে এগিয়ে থাকতেও রাফালের জুড়ি মেলা ভার। আকাশ সুরক্ষা, ক্লোজ এয়ার সাপোর্ট, ইনডেপথ স্ট্রাইক, নজরদারি, জাহাজ বিধ্বংসী আঘাত হানার ক্ষমতা এবং সর্বোপরি পারমাণবিক অস্ত্র বহন করার ক্ষমতাই রাফালকে অন্য প্রায় সব যুদ্ধবিমানের থেকে কয়েক কদম এগিয়ে রেখেছে।
আকাশযুদ্ধে ‘এয়ার সুপ্রিমেসি’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিপক্ষের যুদ্ধবিমানকে সব দিক দিয়ে টেক্কা দিয়ে গোটা আকাশসীমায় আধিপত্য কায়েম করাকে কৌশলগত পরিভাষায় এয়ার সুপ্রিম্যাসি বলা হয়। আর এক্ষেত্রেও রাফালের বিকল্প খুঁজে পাওয়া কঠিন।
ইন্টারডিকশন বা ডিপ এয়ার সাপোর্ট দিতে এই ফরাসি যুদ্ধবিমান অত্যন্ত দক্ষ। যে ভূখণ্ডে আকাশপথে হামলা চালানো হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই সেই ভূখণ্ড শত্রুপক্ষের দখলে থাকে। ফলে মাটির খুব কাছাকাছি পৌঁছে হামলা চালানো যায় না। অনেক উঁচু থেকে শত্রুর ঘাঁটি ধ্বংস করতে হয়। রাফাল অনায়াসেই সেই কাজ করতে পারে।
মাটিতে দু’পক্ষের যুদ্ধের সময় পদাতিক বাহিনীকে আকাশপথে সুরক্ষা দেওয়া অন্যতম সমরকৌশল। এতে এক দিকে যেমন সেনার মনোবল বাড়ে, তেমনই চাপমুক্ত হয়ে প্রতিপক্ষের উপর হামলা চালাতে পারে। সামরিক পরিভাষায় একে বলা হয় গ্রাউন্ড সাপোর্ট। দুই পদাতিক বাহিনীর যুদ্ধের সময় মাটির কাছাকাছি এসে শত্রুপক্ষের উপর হামলা চালাতে যে রাফাল পারদর্শী, তার প্রমাণও মিলেছে ইতিমধ্যেই।
আবার যুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষ সেনার অবস্থান ও প্রকৄতি বুঝতে পারলেই কোথায় হামলা চালানো হবে, কী ভাবে হবে- সেই সব কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। এই রণকৌশলেও রাফাল সুদক্ষ। আকাশে অনেক দূর থেকেও শত্রুপক্ষের সেনা ঘাঁটি ও সমর সকরঞ্জামের নিখুঁত ছবি তুলে পাঠাতে পারে।
এর পাশাপাশি শত্রুপক্ষের রেডার জ্যাম করতে পারে। জল, স্থল হোক বা আকাশ— তিন ক্ষেত্রেই শত্রুপক্ষকে চিহ্নিত করতে পারে এবং নিখুঁত নিশানায় আঘাত করতে পারে।
এই সব সাধারণ প্রযুক্তি তো রয়েছেই, তার সঙ্গে ভারতের জন্য আবার নির্দিষ্ট করে কিছু বৈশিষ্ট যুক্ত হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম উচ্চ অক্ষাংশ থেকে আকাশে ওড়ার ক্ষমতা। লেহ-র ভারতীয় বায়ুসেনা ঘাঁটির কথা মাথায় রেখেই অতিরিক্ত এই বৈশিষ্ট্য যোগ হয়েছে ভারতের রাফালগুলিতে।
সোমবারই ফ্রান্স থেকে ভারতের উদ্দেশে উড়েছে প্রথম দফার পাঁচটি রাফাল। বুধবার পৌঁছবে অম্বালায় ভারতীয় বায়ুসেনার ঘাঁটিতে। তার পরেই যুক্ত হবে ভারতীয় বায়ুসেনার সঙ্গে।