পাশে: কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে সরব ছাত্রছাত্রীরা। শনিবার অমৃতসরে। ছবি: পিটিআই।
সরকারি হিসেবেই অন্তত ২৫ বার কৃষি আইনের পক্ষে সওয়াল করে ফেলেছেন তিনি। এমন কোনও অনুষ্ঠান বাকি নেই, যেখানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কৃষি আইনের ফলে চাষিদের উপকার হবে বলে দাবি করেননি। কিন্তু কৃষক সংগঠনগুলির অভিযোগ, নতুন তিনটি আইন আসলে ব্যবসায়ী ও শিল্পমহলের স্বার্থে।
শনিবার সেই ব্যবসায়ী ও শিল্পমহলের মঞ্চ থেকেই ফের কৃষি আইনের গুণগান করলেন মোদী। পাশাপাশি, তাঁর মন্ত্রী খলিস্তানি-চিন-পাকিস্তানের পরে এ বার কৃষি আন্দোলনের পিছনে মাওবাদীদের হাত থাকার অভিযোগ তুললেন।
বণিকসভা ফিকি-র বার্ষিক সভায় আজ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘কৃষিতে এই সংস্কারের ফলে সব থেকে বেশি লাভবান যদি কেউ হন, তা আমার দেশের চাষিরা। যাঁরা ছোট-ছোট জমির টুকরোর উপরে জীবন কাটান, তাঁদেরই উপকার হবে।’’ সেই দাবি উড়িয়ে দিল্লি-হরিয়ানা সীমানা অবরোধ করে বসে থাকা কৃষক সংগঠনগুলির নেতাদের অভিযোগ, নয়া আইনের জেরে দেশের চাষআবাদ পুরোপুরি কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। কিন্তু মোদীর যুক্তি, ‘‘দেশের অর্থব্যবস্থায় বিভিন্ন ক্ষেত্রের মধ্যে প্রাচীর নয়, আরও বেশি সেতুবন্ধন দরকার। যাতে তারা একে অন্যকে সাহায্য করতে পারে।’’
আরও পড়ুন: রবীন্দ্রনাথের জাতীয় সঙ্গীত এ বার বদলাতে চান স্বামী
আরও পড়ুন: ধর্ষণ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য কমিশন প্রধানের
এই অবস্থায় কৃষকসভার নেতা হান্নান মোল্লার প্রশ্ন, ‘‘মন্ত্রীরা কৃষি আইনের উপকারিতা আন্দোলনকারী চাষিদের সামনে গিয়ে বোঝাচ্ছেন না কেন?’’ অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার প্রকাশ সিংহের মতে, প্রধানমন্ত্রীর উচিত নিজের হাতে চাষিদের বিক্ষোভ সামলানো। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়ার আগে তাঁর এ বিষয়ে রাষ্ট্রের উদ্দেশে বক্তৃতা করা উচিত। পঞ্জাবের কংগ্রেস নেতা প্রতাপ সিংহ বাজওয়া বলেন, ‘‘আমি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি, উদারতা দেখিয়ে কৃষি আইন প্রত্যাহার করুন। যাতে কৃষক সংগঠন ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে উত্তেজনা ও বিভাজন কমে।’’
কিন্তু উত্তেজনা কমানো দূরের কথা, শনিবার থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা অভিযোগ তুলেছেন, কৃষক-আন্দোলন মাওবাদীরা ‘হাইজ্যাক’ করে ফেলেছে। কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিংহ তোমরের সঙ্গে কৃষক সংগঠনগুলির সঙ্গে দৌত্য করা বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়ালের কথায়, ‘‘কৃষকদের প্রতিবাদ অতি-বাম ও মাওবাদীরা হাইজ্যাক করে নিয়েছে। আলোচনায় বাধা দেওয়ার পিছনে তাদের স্বার্থ কাজ করছে। তারা কৃষকদের উপকারিতার থেকে অন্য বিষয়ে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।’’
মোদী সরকারের অভিযোগ, কৃষক আন্দোলনের মধ্যে থেকে উমর খালিদ, শরজিল ইমাম, গৌতম নভলাখা ও ভীমা-কোরেগাঁও কাণ্ডে ধৃতদের মুক্তির দাবি উঠছে। কিন্তু কৃষক সংগঠনগুলির বক্তব্য, এই দাবি তুলছে ভারতীয় কিসান ইউনিয়ন (উগ্রহণ) গোষ্ঠী। তারা কৃষকদের আন্দোলনে যোগ দেয়নি। কৃষকদের সংযুক্ত মোর্চারও অংশ নয়। বরং কেন্দ্রই তাদের আলাদা করে বৈঠকে ডাকছে। ভারতীয় কিসান ইউনিয়ন (টিকায়েত) গোষ্ঠীর নেতা রাকেশ টিকায়েত বলেন, ‘‘সরকারের কাছে যদি খবর থাকে যে কৃষকদের আন্দোলনে নিষিদ্ধ সংগঠনের লোকেরা ঢুকে পড়েছে, তা হলে গোয়েন্দারা তাদের পাকড়াও করছে না কেন? আমরা তো এমন কাউকে পাইনি। পেলে এখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে।’’
কংগ্রেস নেতা রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালার অভিযোগ, ‘‘মোদী সরকারের নীতিই হল কেউ তার বিরোধিতা করলে তাকে ‘মাওবাদী’ বা ‘দেশদ্রোহী’ তকমা দিয়ে দেওয়া। গত ১৭ দিনে ১১ জন কৃষকের প্রাণ গিয়েছে। তার পরেও সরকারের মন গলছে না।’’ সংযুক্ত কৃষক মোর্চার নেতৃত্বের বক্তব্য, প্রথমে কেন্দ্রের মন্ত্রীরা বললেন, কৃষকদের আন্দোলনের পিছনে বিরোধী রাজনৈতিক দলের মদত রয়েছে। তার পরে বলা হল, এর পিছনে খলিস্তানি শক্তি রয়েছে। তার পরে পাকিস্তান-চিনের মদতের কথা বলা হল। এখন আবার মাওবাদীদের কথা বলা হচ্ছে। বস্তুত, প্রধানমন্ত্রী নিজেই একাধিকবার অভিযোগ করেছেন, বিরোধীরা চাষিদের ভুল বোঝাচ্ছেন। আজ ফিকি-র মঞ্চ থেকে তিনি অবশ্য সে পথে হাঁটেননি। তাঁর বক্তব্য, কৃষি সংস্কারের পরে চাষিদের নতুন বাজার, বিকল্প, প্রযুক্তির ফায়দা, আধুনিক হিমঘর মিলবে।
বিজেপি নেতাদের দাবি, পঞ্জাব-হরিয়ানার কিছু কৃষক বাদ দিলে বাকি দেশের কৃষকরা যে মোদী সরকারের সঙ্গেই রয়েছেন, তার প্রমাণ হল, রাজস্থানের পঞ্চায়েত ভোটে বিজেপির জয়। আজ প্রধানমন্ত্রীও একই সুরে বলেছেন, ‘‘জনতা জনার্দনের বিরাট সমর্থন ও বিশ্বাসে তৈরি সরকারের এক আলাদা আত্মবিশ্বাস ও নিষ্ঠা থাকে।’’ এ বারের কৃষি সংস্কারের আগেও যে কৃষি ব্যবস্থাকে মজবুত করতে তাঁর সরকার কাজ করেছে, তারও খতিয়ান দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। শিল্পমহলের কাছে কৃষিতে আরও লগ্নির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার অনুরোধ করে বলেছেন, উদ্যোগপতিরা কৃষিতে যথেষ্ট উৎসাহ দেখাননি।