ফাইল চিত্র।
কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন পদে আইএএস, আইপিএস অফিসারদের ঘাটতি মেটানোর যুক্তিতে সংশ্লিষ্ট ক্যাডার বিধি ‘কঠোর’ ভাবে প্রয়োগের কথা ইতিমধ্যেই জানিয়েছে কেন্দ্র। বার্তা স্পষ্ট। তা হল, রাজ্য ক্যাডারের অফিসারকে কেন্দ্র ডেপুটেশনে নিতে চাইলে, সংশ্লিষ্ট রাজ্যের ওজর-আপত্তি ধোপে টিকবে না। এ নিয়ে বিতর্ক দানা বেঁধেছে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক মহলে। কিন্তু এই প্রেক্ষাপটে রাজ্যের আমলা শিবিরের একাংশের অভিযোগ, প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট সংখ্যায় অফিসার না পাওয়ার তত্ত্ব কেন্দ্র তুলে ধরলেও, বিভিন্ন কেন্দ্রীয় পদে এ রাজ্যের আইএএস অফিসারদের ‘সুযোগ’ ক্রমশ কমেছে বিগত কয়েক বছরে। বিশেষত সমস্যায় পড়ছেন তুলনায় জুনিয়র অফিসারেরা। যাঁরা একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক বছর চাকরি করার পরে বঞ্চিত হচ্ছেন ‘পদোন্নতি’ থেকে।
এমন অভিযোগ কেন?
প্রশাসনিক সূত্র জানাচ্ছে, সাধারণত চাকরি-জীবনের ১৬ বছরের মাথায় এক জন আইএএস অফিসার কেন্দ্রে যুগ্মসচিব পদের জন্য মনোনীত হয়ে থাকেন। অর্থাৎ, ওই পদের জন্য কারও নাম তালিকাভুক্ত হলে তিনি দিল্লি গিয়ে তাতে যোগ দিতে পারেন অথবা রাজ্যেই কাজ করতে পারেন। ২০০০ সালের ব্যাচ পর্যন্ত এই সুযোগ মোটের উপর স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু তার পর থেকে দেখা যাচ্ছে, ১৬ বছর চাকরির পরেও যুগ্মসচিব পদের তালিকায় নামই উঠছে না এ রাজ্যের অনেক অফিসারের। যেমন, ২০০৫ ব্যাচে ওই সুযোগ পেয়েছেন চার জনের মধ্যে এক জন। ২০০১ ও ২০০৪ সালে ওই সংখ্যা শূন্য (বিস্তারিত সঙ্গের সারণিতে)! এক সিনিয়র অফিসারের কথায়, “গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র বা মধ্যপ্রদেশের মতো বড় রাজ্যগুলির সঙ্গে এ বিষয়ে তুলনা করলে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি কিছুটা
খারাপ। কারণ, ওই রাজ্যগুলির ক্যাডারে কোনও বছরে এক জনও যুগ্মসচিব হওয়ার সুযোগ পাননি, তেমন দৃষ্টান্ত কার্যত নেই।”
সিনিয়র আমলাদের ক্ষেত্রে চাকরি-জীবনের ২৫ বছর পরে কেন্দ্রের অতিরিক্ত সচিব বা সচিব পদে যোগদানের সুযোগ আসে। প্রশাসনিক সূত্রের দাবি, এ রাজ্যের ১৯৮৭ ব্যাচের পর থেকে অন্তত ১১ জন আইএএস অফিসার অতিরিক্ত সচিব, সচিব বা তার সমতুল পদে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে পাঁচ জন কেন্দ্রের কোনও পদে রয়েছেন। বাকি ছ’জন রয়েছেন রাজ্যে সরকারের নানা পদে। এখন সারা দেশেই ১৯৯৪ ব্যাচ থেকে অতিরিক্ত সচিব এবং ১৯৯০-৯১ ব্যাচ থেকে সচিব পদে যোগদানের সুযোগ পেতে শুরু করেছেন অফিসারেরা। সংশ্লিষ্ট মহল মনে করিয়ে দিচ্ছে, যুগ্মসচিবের মতো পদে কাজ করার অভিজ্ঞতা না থাকলে, পরে অতিরিক্ত সচিব কিংবা সচিব হওয়াও কিন্তু শক্ত।
এক কর্তার কথায়, “সিনিয়র অফিসারদের পরিস্থিতি তুলনায় কিছুটা ভাল। কিন্তু অন্যান্য রাজ্যের নিরিখে দেখলে, কেন্দ্রীয় পদের জন্য এ রাজ্যের অফিসারদের সুযোগ তুলনায় অনেকটাই কম।”
সমস্যার শিকড় কোথায়?
এ বিষয়ে একাধিক তত্ত্ব রয়েছে প্রশাসনের অন্দরে। প্রথমত, ডেপুটেশনের প্রশ্নে সব দিক যাচাইয়ের প্রথা রয়েছে কেন্দ্রে। অর্থাৎ, কোনও অফিসারের কাজের বার্ষিক রিপোর্ট, সম্পত্তির খতিয়ান ছাড়াও সংশ্লিষ্টকে চেনেন এমন অন্য অফিসারদের থেকে তাঁর সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হয়। গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ বা মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলি থেকে তুলনায় বেশি সংখ্যক অফিসার দিল্লি যান। ফলে তাঁদের চেনা লোকজনই অনেক সময়ে বেশি সুযোগ পেয়ে থাকেন।
দ্বিতীয়ত, তুলনায় জুনিয়র অফিসারদের কেন্দ্রীয় ডেপুটেশনে ছাড়তে চায় না রাজ্য। ফলে ইচ্ছা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের যুগ্মসচিব পদে যোগ দিতে পারেন না। সেই কারণে তাঁদের পরবর্তী পদোন্নতির সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
তৃতীয়ত, সারা দেশে নির্দিষ্ট একটি ব্যাচে যত জন আইএএস অফিসার থাকেন, সাধারণত তার ৫০-৬০ শতাংশকে এই সুযোগ দেওয়া হয়। ফলে কোনও রাজ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যাচে অফিসারের সংখ্যা কম থাকলে, সুযোগ কম পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ রাজ্যে বাম আমলে এক-একটি ব্যাচে কম সংখ্যায় অফিসার নেওয়া হত। অন্য বড় রাজ্যগুলিতে এক-একটি ব্যাচের অফিসার সংখ্যা তুলনায় বেশি থেকেছে বরাবরই। এখন প্রতি ব্যাচে অফিসারের সংখ্যা বাড়লেও, কোনও বছর এক জনও সুযোগ পাবেন না, এমন হওয়া বিরল।
প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, কেন্দ্রে বিভিন্ন রাজ্য থেকে যত সংখ্যায় অফিসারদের যাওয়ার কথা (কেন্দ্রীয় ডেপুটেশন রিজ়ার্ভ), তা পাঠানো হলে, অভাব এবং এই ‘সঙ্কট’ তৈরি হত না। আবার কেন্দ্রের চাকরিতে রাজ্য থেকে যাওয়া অফিসারেরা সর্বভারতীয় স্তরে কাজের সুযোগ পেয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করলে, তা রাজ্যেরই কাজে লাগে। পুরো বিষয়টিতে কেন্দ্র-রাজ্যের সম্মতি এবং সহাবস্থান থাকলে, কাজের মান আরও বাড়বে বলে তাঁদের দাবি।