দুষ্মন্ত চৌটালা।
‘বাতাও মোদীজি! কেন আপনি ভুলে যান, আপনি মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় গুজরাতে দাঙ্গা হয়েছিল। তাঁদের ন্যায়বিচার দিতে পেরেছেন?’
হরিয়ানায় লোকসভা ভোটের প্রচারে গিয়ে নরেন্দ্র মোদী শিখ-দাঙ্গার কথা বলেছিলেন। তার জবাবে সেদিন হরিয়ানার জাঠ নেতা দুষ্মন্ত চৌটালা ভিডিয়ো বার্তায় মোদীকে গুজরাতের দাঙ্গার কথা স্মরণ করিয়েছিলেন। এ বার বিধানসভা ভোটেও দুষ্মন্তের প্রধান অস্ত্র ছিল, বিজেপি-বিরোধিতা।
ভোটের পরে সেই দুষ্মন্তের জননায়ক জনতা পার্টি এ বার বিজেপির সঙ্গে। মুখ্যমন্ত্রী-উপমুখ্যমন্ত্রীর বাঁধনে। আজ রফা হয়ে যেতেই দুষ্মন্তের পিতা, দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত অজয় চৌটালা দু’সপ্তাহের জন্য তিহাড় জেল থেকে সাময়িক ছুটি পেয়েছেন। পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং বাড়িতে পুজোর জন্য ছুটি চেয়েছিলেন তিনি।
ফলে প্রশ্নটা ফের উঠেছে, এ দেশের রাজনীতিতে নীতি বা নৈতিকতা কি এ বার প্রকাশ্যে বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে? ইতালীয় নবজাগরণের অন্যতম প্রাণপুরুষ নিকোলো মাকিয়াভেলি যে লিখেছিলেন, ‘রাজনীতিতে নৈতিকতার কোনও স্থান নেই’, তা অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ করে ছাড়ছেন রাজনীতিকরা?
বিরোধীরা বিজেপি-র দিকে আঙুল তুলে বলছে, যে কোনও মূল্যে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে বিজেপি বিপুল টাকা ছড়াচ্ছে। নীতি-নৈতিকতাকে মূল্য দিচ্ছে না। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও রাজ্যে রাজ্যে নির্দল বিধায়কদের কিনে নিয়ে সরকার গড়ছে। উদাহরণ দিয়ে তাঁরা বলছেন, দুষ্মন্তের সমর্থন না পাওয়া যাবে কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার আগে পর্যন্ত হরিয়ানায় বিজেপি ফের সরকার গড়তে নির্দল প্রার্থীদের উপরে ভরসা করছিল। রাজনৈতিক শিবিরে রসিকতা চলছিল, ‘বিজেপি ধনতেরাসে বিধায়ক কিনছে!’ ‘কেনাবেচা’-র এই হাটে অচ্ছুৎ থাকেননি ধর্ষণ, আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে জেল খাটা গোপাল কান্ডার মতো নেতাও।
দুষ্মন্তের সমর্থন পেয়ে যাওয়ায় বিজেপি নেতা রবিশঙ্কর প্রসাদ আজ জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা কান্ডার সমর্থন নিচ্ছেন না। কিন্তু দুষ্মন্ত সঙ্গে না এলে এই কান্ডাই যে কান্ডারি হয়ে উঠতেন, তা নিয়ে বিজেপির নেতাদের মনেই সংশয় নেই। কংগ্রেস নেতা রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালা বলেন, ‘‘ভোটের আগে বিজেপি দুষ্মন্তকে ঘরে আগুন লাগানো বাঁদর বলেছিল। জেজেপি বিজেপি-কে রাজ্যে আগুন লাগানো রাবণ আখ্যা দিয়েছিল। ভোটের পরে ঘরে আগুন লাগানো, রাজ্যে আগুন লাগানো দল মিলে সরকার গড়ছেন। কী ফুল ফোটাবেন?’’
পাল্টা আঙুল তুলেছে বিজেপি-ও। বিজেপি নেতাদের অভিযোগ, কর্নাটকে কংগ্রেস-জেডি(এস) মিলে টাকা ছড়িয়েই সরকার গড়েছিল। তার হোতা কংগ্রেস নেতা ডি কে শিবকুমার তিহাড় থেকে ছাড়া পেয়ে রাজ্যে ফিরেছেন। কর্নাটক বিজেপি-র
প্রশ্ন, ‘আর্থিক নয়ছয়, দুর্নীতিতে অভিযুক্ত নেতা জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তাঁকে নায়কের মতো স্বাগত জানানো দলের মানসিকতা কী রকম হতে পারে?’’
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অপূর্বানন্দের বিশ্লেষণ, জওহরলাল নেহরু-লালবাহাদুর শাস্ত্রীর পর থেকেই এ দেশের রাজনীতিতে নৈতিকতার ক্ষয় শুরু। অপূর্বানন্দ বলেন, ‘‘১৯৫৭-তে নেহরু কংগ্রেস নেতাদের বলেছিলেন, আমরা ভোটে হারলেও নৈতিকতা বিসর্জন দেব না। স্বাধীনতার মাত্র দশ বছর পরের ঘটনা। তখন কংগ্রেসের আধিপত্য।
কিন্তু পরে ইন্দিরা গাঁধীর জমানায় লোহিয়ার উত্থানে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে কংগ্রেসই নৈতিকতা বিসর্জন দেয়। রাজ্যে রাজ্যে নির্বাচিত কংগ্রেস-বিরোধী সরকারকে উৎখাত করা হয়।’’ তাঁর মতে, এখন যেমন কংগ্রেসের ক্ষমতায় আসা থেকে আটকাতে বিজেপি আঞ্চলিক দলের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে, তেমনই বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহের আমলে বিজেপি-বাম মিলে জনতা পার্টির সরকারকে সমর্থন করেছিল।
অপূর্বানন্দের বক্তব্য, ‘‘এখন অবশ্য বিজেপি বাকিদের ছাপিয়ে গিয়েছে। কারণ, অর্থবল। তাই ভোটের রায় বিরোধী আসনে বসার হলেও সেই রায় মানা হচ্ছে না।’’