ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়।
ঠিক যেন সিঁড়ি বেয়ে ধাপে ধাপে ওঠা। গুয়াহাটির সাধারণ মেয়ে থেকে কোটিপতি হওয়ার পথে ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায় একের পর এক সঙ্গী বেছে নিয়ে ক্রমাগত উপরে উঠতে চাইতেন বলেই জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা।
মিখাইল ও শিনার বাবা সিদ্ধার্থই যে ইন্দ্রাণীর জীবনে প্রথম পুরুষ, তা নয়। আবার সিদ্ধার্থকে বিয়ে করার পরেও তাঁকে ছাড়তে সময় নেননি ইন্দ্রাণী। মিখাইল-শিনাকে গুয়াহাটিতে বাবা-মার হেফাজতে রেখে সিদ্ধার্থর ভাইকে নিয়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন তিনি। এখানে এসে দেওরকে ছেড়ে বিয়ে করেছিলেন সঞ্জীব খন্নাকে। স়়ঞ্জীবের ঘরণী হিসেবেই বেশ কয়েক বছর কলকাতা থাকার পর এই পক্ষের মেয়ে বিধিকে ছেড়ে ফের অন্য এক পুরুষের হাত ধরে মুম্বই পাড়ি দেন। ইন্দ্রাণীর এ বারের সঙ্গী-পুরুষটি ভারতীয় থিয়েটার জগতের বিখ্যাত মানুষ। তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, কলকাতায় থাকতেই ইন্দ্রাণী বুঝতে পেরেছিলেন, ওই মানুষটি তাঁকে পৌঁছে দিতে পারবেন মুম্বইয়ের উঁচু মহলে। তাঁর হাত ধরে মুম্বই পৌঁছে তিনি আরও উপরের ধাপে ওঠার চেষ্টা করেন। সেই জন্যই মিডিয়া জগতের নামকরা ব্যক্তিত্ব পিটার মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেন।
সঞ্জীব ও ইন্দ্রাণীর ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গিয়েছে, কলকাতায় যে কয়েকটা বছর ইন্দ্রাণী ছিলেন, পার্টি করে, নেচে-গেয়ে জীবন কাটিয়েছেন। কলকাতার তাঁর সঙ্গে মিশেছেন এমন মানুষদের কথায়, ইন্দ্রাণীর নজর ছিল সমাজের উচ্চ স্তরের দিকে। পার্টিতে কোনও ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে কথা বলার সময়ে যদি উঁচুতলার কাউকে ঢুকতে দেখতেন, বন্ধুকে পিছনে ফেলে তাঁর সঙ্গে যেচে আলাপ করতে বিশেষ সময় লাগত না ইন্দ্রাণীর। ঘনিষ্ঠ মহলের মতে, পুরুষদের আকর্ষণ করার সহজাত ক্ষমতাও ছিল তাঁর। পার্টিতে তাঁর সঙ্গে নাচার জন্য পুরুষদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত।
সঞ্জীব খন্নার ঘনিষ্ঠ ডি জে ক্লের ও সুচি ক্লের। — নিজস্ব চিত্র।
সঞ্জীবের কলেজের প্রাক্তনী, কলকাতার বাসিন্দা উইং কম্যান্ডার ডি জে ক্লের ছিলেন তাঁর পারিবারিক বন্ধু। সঞ্জীব ছিলেন তাঁর ছেলের থেকে সামান্য বড়। তাঁর স্ত্রীকে মাম্মি বলেই ডাকতেন সঞ্জীব। প্রাক্তন এই সেনা অফিসার ও তাঁর স্ত্রী সুচি ক্লের এ দিন জানান, সঞ্জীব ও ইন্দ্রাণী ছিলেন সুখী দম্পতি। সঞ্জীবকে সবাই চিনতেন সদা হাস্যময় পুরুষ হিসেবে। ডি জে-র কথায়, ‘‘অনেকটা বিন্দাস-টাইপের মানুষ সঞ্জীব।’’ তাঁদের কথায়, মেয়ে বিধিকে খুব ভালবাসতেন সঞ্জীব। তাই ২০০০ সালে ইন্দ্রাণী মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে মুম্বই চলে যাওয়ার পরে প্রথমে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। ২০০২ সালে কাগজে কলমে বিবাহবিচ্ছেদ হয় তাঁদের। সেনা অফিসারের কথায়, ‘‘ইন্দ্রাণীর সঙ্গে বিচ্ছেদ সামলে নিতে বেশি সময় নেয়নি সঞ্জু। কিন্তু মেয়ে ছিল তাঁর উইক-পয়েন্ট। মেয়ের জন্যই ইন্দ্রাণীর সঙ্গে ও যোগাযোগ রাখত।’’ মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য আদালতেরও দ্বারস্থ হয়েছিলেন সঞ্জীব। মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে মাঝেমধ্যে মুম্বইও যেতেন। যদিও সঞ্জীবের মেয়েকে পিটারই দত্তক নিয়েছিলেন। বিধি তাই পিটারের পদবিই ব্যবহার করে থাকেন।
কিন্তু পিটার যেমন মিখাইল-শিনার প্রকৃত পরিচয় জানতেন না, সঞ্জীব বা তাঁর ঘনিষ্ঠরাও তা জানতেন না। সুচির কথায়, ‘‘আমরা এত বছর ধরে এত কাছাকাছি থেকেছি, একসঙ্গে এত পার্টিতে গেছি, কোনও দিন ঘুণাক্ষরেও জানতে পারিনি, ইন্দ্রাণীর আগে বিয়ে হয়েছিল বা দু’টি বাচ্চা ছিল।’’ তবে ইন্দ্রাণী যে অতীতকে অস্বীকার করতে পারদর্শী, সে পরিচয় ওঁরা পেয়েছিলেন। সুচি বলেন, ‘‘ওদের বিবাহবিচ্ছেদের পর আমি অনেক বার মুম্বই গিয়েছি। কিন্তু কখনও ইন্দ্রাণীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করিনি।’’ কেন? সুচি বলেন, ‘‘ ও সমাজের যে স্তরে পৌঁছে গিয়েছিল, যাদের সঙ্গে মেলামেশায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল, তা থেকে ভালই বুঝতে পেরেছিলাম, ও এখন আর আমার ফোন ধরবে না।’’
কী করে স়ঞ্জীবের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ইন্দ্রাণীর?
ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন, ১৯৯৩ সালে সঞ্জীবের সঙ্গে একটি কম্পিউটার ক্লাসে আলাপ হয়েছিল ইন্দ্রাণীর। তখন তিনি মিডলটন স্ট্রিটে থাকতেন। সুপুরুষ, বিত্তবান, সমাজের উচ্চস্তরে মেলামেশা করা সঞ্জীবের সঙ্গে আলাপের কিছু দিনের মধ্যেই বিয়ে হয় তাঁদের। বিধি জন্মায় এর কয়েক বছরের মধ্যেই। এই সময় সঞ্জীব থাকতেন হেস্টিংসের চ্যাপেল রোডে মামাবাড়িতে। তাঁর মামা গৌরমোহন কপূর প্রতিষ্ঠিত স্থপতি। এ দিন তাঁদের প্রতিবেশী মধুকর সিংহ বলেন, ‘‘গৌরবাবুকে আমরা খুবই শ্রদ্ধা করি।’’ তিনিই জানান, সঞ্জীব প্রথম জীবনে একটি ব্যাঙ্কে চাকরি করতেন। পরে চাকরি ছেড়ে নিজের ব্যবসা শুরু করেন। মামাবাড়িতে বিধবা মা-কে নিয়ে থাকতেন। পরে ইন্দ্রাণীকে বিয়ে করে মামাবাড়ি
ছেড়ে চলে যান শিবপুরের একটি ফ্ল্যাটে। কলকাতার একটি অভিজাত ক্লাবের সদস্য ছিলেন সঞ্জীব।
স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে প্রায় নিয়মিতই যেতেন তিনি।