গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফর ঘিরে, সামান্য হলেও, আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু জনমানসে তা নিয়ে আবেগের আতিশয্য কিছু নেই, প্রত্যাশাও নেহাতই কম। বিশেষ করে, সফরের আগেই ট্রাম্প যখন স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, দীর্ঘ দিন ধরে ঝুলে থাকা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি এই সফরেও বাস্তবায়িত করা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু তা হলেও ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ক্রমোন্নতির যে ধারা গত দু’দশক ধরে ফুটে উঠছে, তার প্রেক্ষিতে ট্রাম্পের এই ভারত সফর একটি সদর্থক পদক্ষেপ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে ঠান্ডা লড়াইয়ের সূচনা হয়েছিল, ভারত-মার্কিন সম্পর্ক সেই প্রথা মেনেই এগিয়েছে। জোট নিরপেক্ষ ভারত আর চিন ও পাকিস্তানের দোসর আমেরিকার মধ্যে কার্যকরী সদ্ভাব গড়ে ওঠা সম্ভব ছিল না। বরং ভারত আরও বেশি করে সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে পড়েছে।
হাওয়া ঘুরে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং ঠান্ডা লড়াই শেষ হয়ে যাওয়ার পর। মার্কিন কর্তৃত্বের সম্ভাব্য প্রতিযোগী হিসাবে উঠে আসে চিন। আর চিনের প্রাধান্য ঠেকিয়ে রাখতে আমেরিকা নতুন বন্ধু রাষ্ট্রের খোঁজতল্লাশ শুরু করে। গত শতকের শেষের দিকে ভারতকে নতুন চোখে দেখতে থাকে। ইতিমধ্যে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন আসে। দেখা যায়, দু’টি মুখ্য গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে তেমন কোনও বিষয় নেই, যা নিয়ে দ্বিপাক্ষিক স্তরে চরম বিবাদের সম্ভাবনা থাকতে পারে। বরং সহযোগিতার পথ ধরলে আখেরে দু’দেশেরই লাভ। কারণ, পদ্ধতিগত প্রভেদ থাকলেও তাদের স্বার্থ আর উদ্দেশ্যের মধ্যে মিল অনেকটাই।
একে অন্যের প্রয়োজন বোঝে ৩০ বছর আগে
সহজ কথায়, ভারতের বিশাল বাজারে আরও বেশি পণ্য রফতানি আর পুঁজির অনুপ্রবেশের যেমন লাভজনক দিক রয়েছে, তেমনই বৃহত্তর আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির দাবার চালে আগামী দিনের জোট গড়ে তোলার জন্য ভারতকে পাশে পেতে চায় আমেরিকা।
ট্রাম্প-কার্ড। চার বছর আগে, আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচার।
অন্য দিকে, ভারতের কাছে আমেরিকার সহযোগিতা আন্তর্জাতিক স্তরে তার সুরক্ষা এবং ক্ষমতা-বৃদ্ধির সহায়ক। আমেরিকার সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন-ঘনিষ্ঠ দেশগুলিও ভারত সম্পর্কে উৎসাহী। তাই দু’টি দেশের পরস্পরের কাছাকাছি আসার যথেষ্টই কারণ রয়েছে। যা এই দুই দেশের সমসাময়িক দুই নেতার ব্যক্তিগত রসায়নের চেয়েও বেশি প্রভাবশালী।
আরও পড়ুন- ভারতে এসে বাণিজ্যে লাভ হবে না, বুঝে গিয়েছেন ট্রাম্প
বিশ্বের সবক’টি প্রধান দেশের সঙ্গেই এখন কুশলী অংশীদারির (‘স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ’) নীতি নিয়ে চলছে ভারত। আমেরিকার সঙ্গে এই স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ অবশ্য কয়েক কদম এগিয়ে। যার মধ্যে পড়ে অসামরিক পারমাণবিক ক্ষেত্র, মহাকাশ ও উচ্চ প্রযুক্তির লেনদেন, ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবিলা ও প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত বিষয়।
কিন্তু ভারতের কুশলী অংশীদারি রয়েছে চিনের সঙ্গেও। তাই নিজের জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে আমেরিকার হাত ধরে চলতে পারে না ভারত। দু’টি দেশের মধ্যে স্বার্থের যতটুকু মিল, সম্পর্ক ততটুকুই মজবুত হতে পারে। তার বেশি কিছু প্রত্যাশিতও নয়।
ভারত-মার্কিন সম্পর্কের টানাপড়েনের সূত্রপাত
এখানেই অবশ্য ভারত ও আমেরিকার সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু। বুশ আর ওবামার জমানায় আমেরিকার ভাবনা ছিল, ভারতকে আরও বেশি করে আন্তর্জাতিক পরিসরে জায়গা করে দেওয়া। ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও আর্থিক লেনদেন বাড়িয়ে তোলা। ভারতের ক্ষমতা-বৃদ্ধি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সদর্থক ভূমিকা নেবে, এমন একটা ধারণা থেকেই দু’টি দেশের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া শুরু। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হিসেবি মানুষ। কী পেলাম আর কী দিলাম, দিনের শেষে লাভের কড়ি ঘরে উঠল কি না, এই সব হিসাব নিয়েই তিনি আছেন। থাকেন।
মোদী-মন্ত্র। ছয় বছর আগে ভারতে নির্বাচনী প্রচারে নরেন্দ্র মোদী।
তাই এটা একেবারেই বিস্ময়ের নয়, তাঁর আমলে ভারত-মার্কিন সম্পর্কের তাৎপর্য আর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে চিনের থেকে এখনও অনেকটাই পিছিয়ে ভারত। এমনও নয় যে, অদূর ভবিষ্যতে সক্রিয় চিন-বিরোধী শক্তি হিসাবে ভারতের আত্মপ্রকাশের সম্ভাবনা রয়েছে। বরং ‘উহান স্পিরিট’ বা ‘চেন্নাই কানেক্ট’ নামে খ্যাত মোদী-চিনফিং বৈঠক অন্য রকমের সম্ভাবনা উস্কে দেয়।
আরও পড়ুন- ভারতে গিয়ে ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলবেন ট্রাম্প
কাজেই ট্রাম্পের হিসাবে ‘অন্যায় সুবিধা’ পেয়ে আসছে ভারত। বিগত বছরগুলিতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বেড়েছে অনেকটাই। সেই অনুপাতে মার্কিন পুঁজি অবশ্য আসেনি ভারতে। এ বার বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও ট্রাম্প ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি নিয়ে এলেন। চিনের সঙ্গে শুল্ক নিয়ে দর কষাকষির সঙ্গে সঙ্গে ভারতকেও নজরে রাখলেন ট্রাম্প। ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়ামের মতো বেশ কয়েকটি ভারতীয় পণ্য রফতানির উপর শুল্কের বোঝা চাপিয়ে দিলেন। ‘জেনারালাইজড সিস্টেম অফ প্রেফারেন্স (জিএসপি)’, যার আওতায় ভারত এত দিন বিশাল মূল্যের পণ্যাদি বিনা শুল্কে রফতানি করতে পারত, সেই সুবিধা ট্রাম্প তুলে দিলেন। নির্দেশ দিলেন, ‘জি-২০’ জোটের সদস্য রাষ্ট্র ভারতকে আর উন্নয়নশীল দেশগুলির প্রাপ্য সুযোগসুবিধা দেওয়া যাবে না। বাণিজ্যে আমেরিকার ঘাটতি পূরণের জন্য আমেরিকার কৃষি ও ডেয়ারি পণ্যাদির রফতানি চান ট্রাম্প। কিন্তু ভারত তাতে রাজি নয়। বরং কিছুটা হলেও, সামরিক অস্ত্র কিনে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি পুষিয়ে দিতে পারে ভারত।
চমকপ্রদ কোনও সমঝোতা হবে কি?
এ হেন পরিস্থিতিতে দু’দেশের মধ্যে চমকপ্রদ কোনও সমঝোতা হওয়ার আশা ক্ষীণ। তবুও গরজ বড় বালাই! আমেরিকায় ‘হাউডি মোদী’ অনুষ্ঠানে ট্রাম্প নিজেকে ভারতের ‘সর্বকালের সেরা বন্ধু’ বলে দাবি করেছেন। ‘নমস্তে ট্রাম্প’ অনুষ্ঠানেও তার ব্যাতিক্রম ঘটবে না। মার্কিন মুলুকে আসন্ন নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে পুনর্নির্বাচিত হতে প্রবাসী ভারতীয়দের উপর নজর থাকবে ট্রাম্পের। তাই ভারত-বন্ধু হিসাবে একটা ইমেজ গড়ে তুলতে তিনি সচেষ্ট থাকবেন। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি অন্য কথা বলে।
ট্রাম্প ২০২০। ফের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
ভারতের অর্থনীতির এখন সুসময় নয়। বৃদ্ধির হার আশা জাগাতে পারছে না। শিল্পে মন্দা। বাড়ছে বেকারি। এই সময় ভারত আরও বেশি করে চাইছে আমেরিকার খোলা বাজার। আরও বেশি রফতানির সুবিধা। ভারতীয় পেশাদারদের জন্য উদার ভিসা-নীতি। উন্নত প্রযুক্তি আর পুঁজি। পরিবর্তে ট্রাম্প যদি চাপ সৃষ্টি করার পথ বেছে নেন, তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। যা এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ পাল্টে দিতে পারে। আর এই টানাপড়েনেই ভারত-মার্কিন বাণিজ্য চুক্তি আপাতত শিকেয়।
সমঝোতার যে ক্ষেত্রগুলি খোলা থাকছে
তবুও কুশলী অংশীদারির পথে হেঁটেই আলোচনার ও সমঝোতার বেশ কয়েকটি ক্ষেত্র খোলা থাকছে। ২০০৪ সালে ঘোষিত ‘নেক্সট স্টেপ্স ইন স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ (এনএসএসপি)’ আগেই উল্লিখিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সহযোগিতার রূপরখা তৈরি করে দিয়েছে। সম্পর্কের চড়াই-উতরাই থাকলেও, ভারত-মার্কিন সম্পর্ক প্রত্যাশিত পথেই ক্রমবর্ধমান। সেই দিক থেকে কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফরের গুরুত্ব রয়েছে।
‘নমস্তে ট্রাম্প’ একটি চমকদার অনুষ্ঠান হতে চলেছে। তার পর কয়েকটি সমঝোতাপত্র (‘মেমোরেন্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ বা ‘মউ’) স্বাক্ষরিত হবে, যা এনএসএসপি-র সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই হওয়া সম্ভব। তাই শোনা যাচ্ছে, প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি মাল্টি-রোল হেলিকপ্টার কিনতে চলেছে ভারত। পরমাণু চুল্লি সরবরাহ মারফত অন্ধ্রপ্রদেশে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পথ খুলতে পারে। বাড়তে পারে মহাকাশ গবেষণার যৌথ পরিসর, সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান। স্বাস্থ্য পরিষেবা সংক্রান্ত বিষয়, বিশেষ করে, ভারতের প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি এবং জেনেরিক মেডিসিন মার্কিন বাজারে পৌঁছে দেওয়া, মনোরোগ সংক্রান্ত গবেষণাও মোদী ও ট্রাম্পের আলোচনার বিষয় হতে পারে।
ফের ট্রাম্পের ‘বন্ধু’ হয়ে উঠতে পারেন মোদী!
একই সঙ্গে কোনও কোনও ক্ষেত্রে শুল্ক কমিয়ে দিতে পারে ভারত, যাতে ট্রাম্প তাঁর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির বড়াই চালিয়ে যেতে পারেন। ভারতীয় পণ্যাদির উপর আমেরিকা শুল্কের বোঝা চাপানোর প্রত্যুত্তরে ভারতও মার্কিন পণ্যাদির উপর শুল্কের বোঝা চাপিয়েছে। এই শুল্ক-লড়াইয়ে প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে মার্কিন সংস্থা ‘হার্লে ডেভিডসন’-এর বানানো মোটরসাইকেলের উপর চাপানো কর। এই কর কমানো হলে তা একটা সদর্থক বার্তা পৌঁছে দেবে এবং সে ক্ষেত্রে ভাবী বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে সদিচ্ছার আভাসও পাওয়া যেতে পারে।
আবার মোদী এবং ট্রাম্প, দু’জনেই যেহেতু প্রথা-বহির্ভূত চমক দিতে সিদ্ধহস্ত, তাই এই সফরে অপ্রত্যাশিত কোনও ঘোষণাও শোনা যেতে পারে।
এ ছাড়াও, আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরও বেশি পরিমাণে ভারত-মার্কিন বোঝাপড়া জরুরি। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নৌযান চলাচলের স্বাধীনতার বিষয়ে ভারত ও আমেরিকার ধারণা মোটামুটি এক। কিন্তু ভারতকে চিন্তায় রাখবে আফগানিস্তানে তালিবানদের সঙ্গে আসন্ন মার্কিন শান্তি চুক্তি। যার ফলে, আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা সৈন্য সরিয়ে নেবে। তাই চুক্তির পর আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী হবে, ভারত, পাকিস্তান ও আমেরিকার সম্ভাব্য ভূমিকা কী হবে, সেগুলি অবশ্যই মোদী ও ট্রাম্পের আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত।
ট্রাম্পের নানা বাগাড়ম্বর সত্ত্বেও ভারত-মার্কিন সম্পর্ক এখন যে চেহারা নিয়েছে, তা দু’টি গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে স্বাভাবিক বোঝাপড়ার সম্পর্ক। তাতে আশা আছে, হতাশা রয়েছে। সহযোগিতা আছে, আবার নিজের নিজের স্বার্থ নিয়ে লড়াইও আছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সফর এ সম্পর্কে একটা মোহরের ছাপ মাত্র!
লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের অধ্যাপক
ফাইল ছবি