দল ছাড়লেন দীনেশ ত্রিবেদী। ফাইল চিত্র।
নাটকীয় ভাবে তৃণমূল ছাড়লেন দীনেশ ত্রিবেদী। পাশাপাশি রাজ্যসভার সাংসদপদও ছেড়ে দিয়েছেন। বস্তুত, রাজ্যসভাতেই তাঁর ওই সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছেন দীনেশ। বলেছেন, ‘‘আমার রাজ্যের সর্বত্র হিংসাত্মক ঘটনা ঘটছে। অথচ আমরা কিছু বলতে পারছি না। আমি রবীন্দ্রনাথ, নেতাজির ভূমি থেকে আসা মানুষ। তাই এটা আমি আর দেখতে পারছি না। আমি একটি দলে আছি। তাই দলের শৃঙ্খলা মেনে চলতে হচ্ছে। কিন্তু আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। এর চেয়ে ইস্তফা দিয়ে বাংলায় গিয়ে কাজ করা ভাল।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘আমি আমার অন্তরের ডাক শুনেছি। সকলকেই কখনও না কখনও অন্তরাত্মার ডাক শুনতে হয়।’’
পাশাপাশিই দীনেশ বলেছেন, ‘‘আমি তৃণমূল ছাড়ছি। তবে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জন্য কাজ করতে চাই।’’ জল্পনা, অতঃপর বিজেপি-তে যোগ দিতে পারেন দীনেশ। একদা বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহের ঘনিষ্ঠ এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূলে নিয়ে এসেছিলেন। তৃণমূলে থাকাকালীন তিনি দেশের রেলমন্ত্রী হন। কিন্তু রেলের ভাড়া বাড়ানোয় তাঁর উপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন মমতা। কারণ, রেল বাজেট পেশ করতে গিয়ে দীনেশ বলেছিলেন, ‘‘রেল আইসিইউ-য়ে চলে গিয়েছে।’’ ঘটনাচক্রে, দীনেশের অব্যবহিত আগে রেলমন্ত্রী ছিলেন মমতাই। দীনেশের ওই বক্তব্যের পর রাতারাতি তাঁকে রেলমন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
দীনেশের ওই ঘোষণা শুনে রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান দীনেশকে বলেন, ‘‘এ ভাবে ইস্তফা দেওয়া যায় না। এর একটি পদ্ধতি আছে। আপনি রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত ভাবে পদত্যাগপত্র জমা দিন।’’ আশা করা যায়, এর পর দীনেশ আইন মোতাবেক লিখিত ভাবে তাঁর ইস্তফা রাজ্যসভার চেয়ারম্যানকে জমা দেবেন।
দীনেশ যে ভাবে আচম্বিতে দল এবং রাজ্যসভার সাংসদপদ ছাড়ার কথা ঘোষণা করেছেন, তাতে চমকিত তৃণমূল। যদিও সংসদে দীনেশের সতীর্থ প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায় বলেছেন, ‘‘উনি ছেড়ে দেওয়ায় আমরা দুঃখিত। দীনেশ ক্ষুব্ধ ছিলেন। বিভিন্ন আলোচনায় তিনি আমাকে সে কথা বলেছিলেন। দিল্লির কিছু নেতাকেও বলেছিলেন। তবে উনি যে এ ভাবে দল ছেড়ে দেবেন, সেটা সম্পর্কে কোনও ধারণা আমাদের ছিল না।’’ বস্তুত, দীনেশ নিজেও কোনও পরিচিত মহলেই দল ছাড়ার বিষয়ে স্পষ্ট কোনও ইঙ্গিত দেননি। তবে তৃণমূলে থেকে যে তিনি সন্তুষ্ট নন, তা ঘনিষ্ঠমহলে জানিয়েছিলেন।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, বৃহস্পতিবারই দীনেশ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর একটি টুইটকে ‘রিটুইট’ করেছিলেন। যা থেকে তাঁর বিজেপি-তে যোগদানের সম্ভাবনা আরও জোরাল হচ্ছে। গত লোকসভা ভোটে ব্যারাকপুর কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের হয়ে লড়ে হেরে গিয়েছিলেন। জিতেছিলেন অর্জুন সিংহ, যাঁর সঙ্গে জেলার রাজনীতিতে তাঁর দ্বন্দ্ব সুবিদিত। অর্জুন অবশ্য দীনেশের তৃণমূল ত্যাগের কথা শুনে প্রাক্তন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বিজেপি-তে স্বাগত জানিয়েছেন। প্রসঙ্গত, দীনেশ ২০১৪ সালে ব্যারাকপুর আসন থেকে জিতেছিলেন। ২০১৯ সালে ওই আসনের দাবি করেন অর্জুন। দড়ি টানাটানিতে মমতা দীনেশকেই প্রাধান্য দেন। টিকিট না পেয়ে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি-তে যান অর্জুন। এবং তৃণমূলের দীনেশকে হারিয়ে জেতেন। তার পর অবশ্য মমতা দীনেশকে রাজ্যসভায় নিয়ে আসেন।
দীনেশ-অর্জুন দড়ি টানাটানির সময় তৃণমূলের অনেকেই বলেছিলেন, দলের উচিত ছিল অর্জুনকে ব্যারাকপুরের টিকিট দিয়ে দীনেশকে অন্য কোনও লোকসভা আসন থেকে টিকিট দেওয়া। কিন্তু তখন সেটা করা হয়নি। এখন ঘটনাচক্রে, সেই দীনেশই তৃণমূল ছাড়লেন। এবং সব কিছু পরিকল্পনা মাফিক এগোলে পদ্মশিবিরই তাঁর পরবর্তী গন্তব্য হতে চলেছে। ঘটনাচক্রে, একটা সময়ে দীনেশ ছিলেন দিল্লিতে তৃণমূলের ‘মুখ’। বিভিন্ন কূটনৈতিক পরিস্থিতিতে জাতীয় রাজনীতিতে মমতা তাঁকে ব্যবহার করতেন। কারণ, আদতে গুজরাতের বাসিন্দা দীনেশ দিল্লির রাজনীতিতে জলের মাছের মতোই স্বচ্ছন্দ ছিলেন। কিন্তু কালক্রমে মমতার সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বাড়তে থাকে। তারই ফল দীনেশের দলত্যাগ।
দীনেশের পদত্যাগে তাঁর রাজ্যসভার সতীর্থ সুখেন্দুশেখর রায় বলেছেন, ‘‘ওঁর যখন দমবন্ধ হয়ে আসছিল, তখন দল ছেড়ে ভালই করেছেন। নইলে আবার অসুস্থ হয়ে পড়তে পারতেন। কিন্তু একটা বিষয়ে খটকা লাগছে। যখন রাজ্যসভায় আমাদের দলের বলার সময় শেষ হয়ে গিয়েছিল, তখন চেয়ারম্যান কেন ওঁকেই বাজেট নিয়ে বলতে দিলেন! এটা তো নজিরবিহীন। সেই সময়েই সুযোগ পেয়ে উনি গোটা দেশের সামনে ওই কথাগুলো বলেছেন। আমাদের ধারনা, ওঁকে কথাগুলো বলার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এটা আমরা ভাল করে খোঁজখবর নিয়ে দেখব।’’
ঘটনাচক্রে, দীনেশ নিজে ভাল সেতার বাজান। নিয়মিতই বাজান। সেই কথা উল্লেখ করে তাঁর এক প্রাক্তন সতীর্থ বলেছেন, ‘‘দীনেশ’দা আলাপের পর বিস্তারে গিয়েছেন। এর পর ঝালায় উঠবেন।’’ অস্যার্থ, বিজেপি-তে যাবেন।