‘মৃত্যুর হোটেল’। নামটা শুনেই কেমন যেন গা ছমছম করে ওঠে। প্রশ্ন জাগতে পারে, তা হলে এই হোটেলে কি শুধু মৃত্যুই হয়? হয় বইকি। না, কোনও অপমৃত্যু নয়, দেশের নানা প্রান্ত থেকে এখানে ‘নিশ্চিন্তে’ মরতে আসেন অনেকে।
অনেকের শেষ বয়সে ইচ্ছা থাকে, যদি মরতেই হয়, তা হলে ‘মৃত্যু হোটেল’-এই যেন তাঁর প্রাণ যায়। আর সেই ইচ্ছাপূরণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন পরিবারের সদস্যরাও। এ পর্যন্ত শুনে কোনও কাল্পনিক গল্প বলে মনে হতে পারে। কিন্তু অবাক করার বিষয় এটাই যে, এ দেশেই রয়েছে এমন একটি হোটেল।
মৃত্যুমুখে থাকা মানুষদের নিয়ে আসা হয় এই হোটেলে। প্রচলিত বিশ্বাস, এই হোটেলে মরলে নাকি মোক্ষলাভ হয়। আর সেই বিশ্বাসের তাগিদেই কয়েকশো কিলোমিটার উজিয়ে মৃত্যুমুখে থাকা ব্যক্তির ইচ্ছাপূরণে ছুটে আসেন তাঁদের পরিবারের সদস্যরা।
হোটেলের নাম কাশীলাভ মুক্তি ভবন। উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে রয়েছে এই হোটেল। এখানে মৃত্যু হলে মোক্ষলাভ হয়, এই বিশ্বাস থেকেই হোটেলটি ‘মুক্তি ভবন’ নামেও পরিচিত।
১৯০৮ সালে এই বাড়িটি তৈরি করা হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে এই বাড়িটিকে মৃত্যুশয্যায় থাকা ব্যক্তিদের সেবা-শুশ্রূষার হাসপাতালে পরিণত করেন শিল্পপতি জইদ দয়াল ডালমিয়া। দোতলা একটি বাড়ি। এই বাড়িতে রয়েছে ১০টি বড় ঘর।
মৃত্যুর সঙ্গে একটা বিষণ্ণতা জড়িয়ে থাকে। যে কোনও মৃত্যুই বেদনাদায়ক। কিন্তু মোক্ষ ভবনে মৃত্যুকে ‘উদ্যাপন’ করা হয়।
হোটেলের দশটি ঘরের কোনওটিই প্রায় কোনও সময় ফাঁকা থাকে না। হোটেলের ভাড়াও বেশি না। প্রতি দিন ২০ টাকা। এই ২০ টাকার মধ্যে বিদ্যুৎবিলও জোড়া আছে। বাকি খরচ বহন করে ডালমিয়া ট্রাস্ট।
একমাত্র মৃত্যুশয্যায় থাকা বয়স্ক মানুষদের জন্যই এই হোটেল। সব ধর্মের মানুষের জন্য অবারিত এই হোটেলের দরজা। তবে কোনও বুকিং নেওয়া হয় না হোটেলে।
মুক্তি ভবন কর্তৃপক্ষের দাবি, কোনও রকম অনুদানও নেওয়া হয় না। এই হোটেলে থাকা ব্যক্তির শেষকৃত্যের ভারও বহন করেন হোটেল কর্তৃপক্ষ।
মুক্তি ভবনের ম্যানেজার অনুরাগ শুক্ল এক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “এখানে মৃত্যুকে কোনও বিষণ্ণতার চোখে দেখা হয় না। এখানে মৃত্যুকে উদ্যাপন করা হয়। এখানে কারও মৃত্যু দেখে শোকের পরিবেশ তৈরি হয় না। কারণ আমরা মনে করি, এই মৃত্যুই তাঁর মোক্ষলাভ।”
শুক্ল জানান, কারও মৃত্যুশ্বাস উঠছে দেখেও কোনও চিকিৎসক, হাসপাতালের ব্যবস্থা করা হয় না। শুধু তাঁর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা হয়।
অনুরাগ শুক্ল আরও জানান, মৃত্যুশয্যায় থাকা প্রতি ব্যক্তির জন্য দু’সপ্তাহ বরাদ্দ থাকে। এই সময়ের মধ্যে মৃত্যু না হলে হোটেল ছেড়ে দিতে অনুরোধ করা হয় ওই ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের।
মৃত্যুশয্যায় থাকা ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর পরিবারের দুই সদস্যকে মুক্তি ভবনে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। তাঁদের খাওয়াদাওয়া, রান্না, বিছানা— সব কিছুরই ব্যবস্থা করে দেন মুক্তি ভবন কর্তৃপক্ষ।
প্রতি বছর এই হোটেলে ৩০০ মানুষ আসেন। হোটেলের চার কর্মী এবং এক জন পুরোহিত তাঁদের দেখাশোনা করেন।
শুধু দেশ নয়, বিদেশ থেকেও অনেক ব্যক্তিকে এই হোটেলে মৃত্যুর জন্য নিয়ে আসা হয় বলে দাবি মুক্তি ভবনের ম্যানেজারের। তাঁর দাবি, মৃত্যুশয্যায় থাকা ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষকে এই হোটেলে নিয়ে আসা হয়েছে। যার মধ্যে ৯০ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে। ‘মোক্ষলাভ’ হয়েছে।