অতুল কুমার। ছবি: সংগৃহীত।
সুপ্রিম কোর্ট থেকে বেরোতেই চওড়া একটা হাসি দেখা গেল তাঁর মুখে। চোখের কোনাটাও জলে ভিজেছিল। এ যে তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা জয়। যার জন্য দীর্ঘ কয়েক মাস দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করতে হয়েছিল তাঁকে। সুপ্রিম কোর্ট থেকে বেরিয়েই উচ্ছ্বসিত অতুল বললেন, ‘‘আমার স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। আর এই স্বপ্ন সাকার করার সুযোগ করে দিল সুপ্রিম কোর্ট।’’
অতুল কুমার। বিহারের মুজফফরনগরের তিতোরা গ্রামের বাসিন্দা। সোমবার সুপ্রিম কোর্টের রায় শোনার পর থেকেই তিতোরা গ্রামের এই পরিবারের খুশির জোয়ার। এ বছর জয়েন্ট এন্ট্রান্স (অ্যাডভান্সড) দিয়েছিলেন অতুল। দলিত পরিবারে বেড়ে ওঠা অতুলের স্বপ্ন আইআইটিতে পড়াশোনা করবেন। রাজেন্দ্র কুমারের চার সন্তানের কনিষ্ঠ অতুল। গত ৯ জুন জয়েন্টের ফল প্রকাশ হয়। পাশও করেছেন তিনি। পুত্রের পাশের খবরে গোটা গ্রামে লাড্ডু বিতরণ করেছিলেন বাবা রাজেন্দ্র। কিন্তু পরবর্তী ঘটনার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না রাজেন্দ্র।
র্যাঙ্ক অনুযায়ী ধানবাদ আইআইটিতে পড়ার সুযোগ পান অতুল। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ার জন্য ভর্তি হওয়ার তোড়জোড় শুরু করেন তিনি। কিন্তু ভর্তি হওয়ার দিনই অতুল এবং তাঁর গোটা পরিবারের উপর যেন ‘বিপর্যয়’ নেমে এল। ভর্তি হওয়ার জন্য ১৭,৫০০ টাকার প্রয়োজন ছিল। রাজেন্দ্র জানান, সেই টাকা জোগাড়ও করে ফেলেছিলেন। কিন্তু সেই টাকা আইআইটিতে জমা করতে মাত্র কয়েক মিনিট দেরি হয়েছিল। রাজেন্দ্রের অভিযোগ, সেই কয়েক মিনিটই অতুলের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দেয়। আইআইটি জানিয়ে দেয়, আর ভর্তি নেওয়া যাবে না। এ কথা শুনে গোটা পরিবারের মাথায় যেন ‘আকাশ ভেঙে পড়ে’।
কিন্তু হার মানেননি রাজেন্দ্র। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে তিনি আদালতের দ্বারস্থ হন জয় ছিনিয়ে আনার লক্ষ্যে। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে থাকেন। সেই মামলা সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছয়। সোমবার ছিল শুনানি। প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্রের ডিভিশন বেঞ্চে অতুলের মামলার শুনানি হয়। আদালতে অতুলদের আইনজীবী জানান, গত ২৪ জুন ধানবাদ আইআইটিতে ভর্তির দিন ছিল। পুত্র অতুলকে ভর্তি করানোর জন্য ১৭,৫০০ টাকা জোগাড়ও করেছিলেন। বিকেল ৫টার মধ্যে ভর্তি হওয়ার কথা ছিল। সেই টাকা পৌনে ৫টায় জোগাড় করতে পেরেছিলেন রাজেন্দ্র। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে অনলাইনে টাকা জমা দিতে পারেননি। ফলে অতুলের ভর্তি হওয়ার সুযোগ নষ্ট হয়। এর পরই অতুলের আইনজীবী আবেদন করেন, তাঁর মক্কেলকে ভর্তি হওয়ার সুযোগ দেওয়া হোক। তাঁর এই আবেদনের বিরোধিতা করেন আইআইটি কর্তৃপক্ষের আইনজীবী। আদালতে তিনি দাবি করেন, অতুল ওই দিন বিকেল ৩টের সময় লগ ইন করেন। তাঁর কাছে অনেক সময়ও ছিল ভর্তির টাকা জমা করানোর জন্য। তা ছাড়া ওই দিন যে ভর্তি এবং কত টাকা লাগবে তা জানিয়েও বেশ কয়েক বারা মেসেজ এবং হোয়াট্সঅ্যাপও করা হয়।
এ কথা শুনে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, ‘‘এ ভাবে একটি তরুণ প্রতিভাকে আমরা বিফলে যেতে দিতে পারি না।’’ আদালত তখন প্রশ্ন করে আইআইটিকে, কেন এই বিষয়ে এত আপত্তি তোলা হচ্ছে? ওই পড়ুয়ার জন্য যদি ভাল কিছু করা যায়, সেটাই তো দেখা উচিত! এর পরই আদালত নির্দেশ দেয়, অতুলকে ভর্তি নিতে হবে এবং সেই একই ব্যাচে। তার পরই প্রধান বিচারপতি অতুলকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘‘অল দ্য বেস্ট। ভাল করে পড়াশোনা করুন।’’
সোমবার ছিল সেই মামলার শুনানি। সুপ্রিম কোর্টের রায় শুনে কেঁদে ফেলে গোটা পরিবার। রায় প্রসঙ্গে অতুলের বাবা রাজেন্দ্র বলেন, ‘‘ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না কী বলব! বিশ্বাস করুন, আমার এই খুশির এক শতাংশও প্রকাশ করতে পারছি না। এই জয়ে আমি খুব খুশি। ছেলের জন্য যত দূর যেতে হবে যাব। প্রয়োজনে শিক্ষাঋণ নেব।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্ট, প্রধান বিচারপতি, আমাদের আইজীবী এবং যাঁরা আমাদের এই লড়াইয়ে পাশে ছিলেন, তাঁদের সকলকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। অনেকেই আমাদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসছেন। অনেক প্রবীণ আইনজীবীও টাকা দেওয়ার জন্য এগিয়ে এসেছেন।’’
তাঁর স্বপ্ন ভেঙে যায়নি। সোমবার সেই স্বপ্নকে আবার নতুন করে দেখাতে সহযোগিতা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। রায় শোনার পর অতুল বলেন, ‘‘যে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছিল, আবার ঠিক পথেই ফিরেছে। আমার জীবনের চাকা আবার গড়াতে শুরু করল।’’