আঁধার করে আসে: ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ার আগেই শহর ঢেকেছে কালো মেঘে। মঙ্গলবার বিকেলে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
ঋতুচক্রে বদল এসেছে কি না, তা নিয়ে আগেই আলোচনা শুরু হয়েছিল। গ্রীষ্মের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার ধারাবাহিক বৃদ্ধি, বর্ষার দিন কমে যাওয়ার পাশাপাশি শীত দেরিতে আসা, সর্বনিম্ন তাপমাত্রায় অসাম্যের মতো একাধিক ঘটনায় তারই প্রতিফলন ধরা পড়েছে বলে মনে করে আবহবিদ মহল। তবে ঋতুচক্র বদলের পাশাপাশি এ বার ঘূর্ণিঝড়ের চক্রেও পরিবর্তন হয়েছে কি না, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে। শুধু তাই নয়, ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতাও আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে বলে অনুমান বিশেষজ্ঞদের।
আবহবিদ-গবেষকদের একটি অংশের এমন অনুমানের কারণ, ২০১৯ সালের ওড়িশায় আছড়ে পড়া ফণী এবং তার পরে এই আমপান। তীব্রতার মাপকাঠির ভিত্তিতে এই দুই মারাত্মক ঘূর্ণিঝড়ই (এক্সট্রিমলি সিভিয়র সাইক্লোন) ভূপৃষ্ঠে আছড়ে পড়ার জন্য মে মাসকে বেছে নিয়েছে। আর তাতেই খটকা লেগেছে আবহবিদ-গবেষকদের। তাঁরা জানাচ্ছেন, সাধারণত এ ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের সময়কাল হল সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বর, এই তিন মাস। ২০১৯ সালের আগে ওড়িশা ও গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড়গুলির নব্বই শতাংশের জন্মকালই ছিল অক্টোবর-নভেম্বর। সে ১৯৯৯ সালে ওড়িশার সুপার সাইক্লোন, ২০১৩ সালের পাইলিন, ২০১৪ সালের হুদহুদ, ২০১৮ সালের তিতলি (সবক’টিই হয়েছিল অক্টোবরে) বা ২০১৯ সালের বুলবুলই (নভেম্বর) হোক না কেন! গত বছরই তার ব্যতিক্রম ঘটে। গত বছর মে-তে ২০০ কিলোমিটারেরও বেশি গতিবেগে ওড়িশায় আছড়ে পড়েছিল ফণী। লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল ওড়িশা। এখনও সেই ছাপ রয়ে গিয়েছে অনেক জায়গায়। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ফের আমপানের চোখরাঙানি।
আবহবিদদের মতে, গত ১৫-২০ বছরের তথ্য ঘাঁটলে দেখা যাবে, মে মাসে সেই অর্থে কোনও সুপার সাইক্লোন হয়নি। ফণী ও আমপান সেখানে ব্যতিক্রম। এক আবহবিজ্ঞানীর কথায়, ‘‘প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হওয়ার কারণে এ ধরনের জলবায়ুগত ব্যতিক্রম (ক্লাইম্যাটিক অ্যানোম্যালি) তৈরি হতে পারে। যে ভাবে দূষণ বাড়ছে, ভূগর্ভ থেকে খনিজ উত্তোলন হচ্ছে, অরণ্য ধ্বংস করা-সহ পরিবেশের একাধিক পরিবর্তন ঘটানো হচ্ছে, তার-ই ফলে এই ধরনের আবহাওয়াজনিত বিপর্যয় (হাইড্রোমেটিয়োরোলজিক্যাল হ্যাজ়ার্ডস) তৈরি হচ্ছে।’’ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অধীনে ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজ়াস্টার ম্যানেজমেন্ট’-এর (এনআইডিএম) রেজ়িলিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডিভিশনের প্রাক্তন প্রধান তথা বর্তমানে আইআইটি, জম্মুর অধ্যাপক চন্দন ঘোষ জানাচ্ছেন, গত বছর মে মাসে ফণী এসেছিল, আবার ওই বছর নভেম্বরে বুলবুল আছড়ে পড়ে, যা সাধারণত হয় না! চন্দনবাবুর কথায়, ‘‘শুধু এ দেশেই ঋতুচক্রের স্বাভাবিক নিয়ম ভেঙে যে ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে, তা নয়। আটলান্টিক, প্রশান্ত মহাসাগরেও এ ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। জাপান, আমেরিকার দিকে তাকালেও বোঝা যাবে, সেখানেও একই অবস্থা।’’
আরও পড়ুন: আমপানের মোকাবিলায় ফোনে মমতাকে সহযোগিতার আশ্বাস অমিতের
‘ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস, ইলাহাবাদ’-এর নির্বাচিত সদস্য তথা দিল্লির ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’-র সেন্টার ফর অ্যাটমস্ফেরিক সায়েন্সেসের অধ্যাপক-গবেষক এ ডি রাও বলেন, ‘‘বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড়গুলির তীব্রতা আগের তুলনায় অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে সেগুলির ফ্রিকোয়েন্সি বেড়েছে না কমেছে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। সে সম্পর্কে সুনিশ্চিত ভাবে কিছু বলতে আরও তথ্য দরকার।’’
আরও পড়ুন: পুরীর মন্দিরে পান্ডাদের ফোন করছেন ভক্তরা
আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গণেশকুমার দাস জানাচ্ছেন, আজ, বুধবার ‘কোর এরিয়া’-য় অর্থাৎ উত্তর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও পূর্ব মেদিনীপুরে আমপান ঘণ্টায় ১৫৫-১৬৫ কিলোমিটার বেগে আছড়ে পড়তে পারে। কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, পশ্চিম মেদিনীপুর ও নদিয়ায় ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাব্য গতিবেগ (উইন্ড স্পিড) হতে পারে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার। গণেশবাবুর কথায়, ‘‘আছড়ে পড়ার (ল্যান্ডফল) সময়ে হাওয়ার গতি কিছুটা কমলেও তা দেড়শো কিলোমিটারের বেশি থাকবে বলেই অনুমান। সেই সময়ে আমপান আর সুপার সাইক্লোন থাকবে না, তা এক্সট্রিমলি সিভিয়র সাইক্লোনে পরিণত হবে। আছড়ে পড়ার পুরো প্রক্রিয়া চলবে প্রায় দু’-তিন ঘণ্টা ধরে।’’