ছবি রয়টার্স।
মূল সমস্যা চাহিদা আর জোগানের। সেই জন্যই দেশবাসীকে ধাপে ধাপে টিকাকরণের আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছে মোদী সরকার। স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রের ইঙ্গিত, প্রাথমিক ভাবে ৩০ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া হতে পারে। আগামী মার্চেই টিকাকরণ শুরু করে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েছে কেন্দ্র।
সম্ভাব্য টিকাপ্রাপকদের তালিকায় একেবারে গোড়ায় রয়েছেন এক কোটি স্বাস্থ্যকর্মী। তার ঠিক পরেই দু’কোটি পুরকর্মী, পুলিশ ও আধাসেনা। তৃতীয় ধাপে কমবেশি ২৬ কোটি মানুষ, যাঁদের বয়স পঞ্চাশের বেশি। চতুর্থ ধাপে থাকবেন এক কোটি মানুষ, যাঁদের বয়স পঞ্চাশের নীচে, কিন্তু ক্যানসার, হার্ট, কিডনি, বা ফুসফুসের সমস্যা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী দেশের সব মানুষকে প্রতিষেধকের আওতায় আনার কথা বললেও গত কাল কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যসচিব রাজেশ ভূষণ জানিয়েছিলেন, সকলকে টিকা দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে না। স্বাস্থ্যকর্তাদের যুক্তি, তাঁদের লক্ষ্য সংক্রমণের শৃঙ্খল (চেন) ভাঙা। তার জন্য ন্যূনতম যত জনকে টিকা দেওয়া প্রয়োজন, প্রথমে তত জনকেই দেওয়ার কথা ভাবছে কেন্দ্র।
আরও পড়ুন: ফাইজার ফার্স্ট, বিশ্বে প্রথম কোভিড টিকাকরণ শুরু হচ্ছে ব্রিটেনে
প্রশ্ন হল, ১৩০ কোটির দেশে সেই ন্যূনতম সংখ্যাটি কত? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু-র প্রতিনিধিরা কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যকর্তাদের জানিয়েছেন, ভারতের মতো দেশে প্রথম ধাপে জনসংখ্যার অন্তত ২৩ শতাংশের টিকাকরণ করা প্রয়োজন। সরকারের মতে, সেই সংখ্যাটি কমবেশি ৩০ কোটির কাছাকাছি।
আবার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল বায়োলজির সিনিয়র বিজ্ঞানী তথা ভাইরোলজিস্ট উপাসনা রায়ের মতে, ‘‘জনসংখ্যার অন্তত ৫০-৬০ শতাংশকে প্রতিষেধক দেওয়া ভাল। টিকাপ্রাপ্তদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হলে তাঁরা নতুন করে সংক্রমিত হবেন না। তাঁদের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনাও কমবে। তখন সংক্রমিত এবং অসংক্রমিত যাঁরা টিকা নেননি— তাঁদের মধ্যে পাঁচিল হয়ে দাঁড়াবেন টিকাপ্রাপ্তরা।’’ এই হিসেবে ভারতে জনতার ৫০-৬০ শতাংশের সংখ্যা হবে প্রায় ৭০ কোটি।
আরও পড়ুন: রাশিয়াতেও আগামী সপ্তাহ থেকে কোভিড টিকাকরণ, ঘোষণা পুতিনের
অগস্টের সেরো সমীক্ষা জানিয়েছে ইতিমধ্যেই আট কোটি ভারতবাসী করোনার শিকার। মার্চে সংখ্যাটা ১৫ কোটি পেরোনোর সম্ভাবনা রয়েছে। উপাসনার মতে, ‘‘যেহেতু একসঙ্গে ওই বিপুল টিকা পাওয়া মুশকিল, তাই যাঁদের করোনা হয়ে গিয়েছে, তাঁদের শরীরে অ্যান্টিবডি থাকায় প্রাথমিক টিকাকরণের তালিকা থেকে তাঁদের বাদ দেওয়া যেতে পারে।’’ এই হিসেবে স্বাস্থ্যকর্তাদের মতে, প্রাথমিক ভাবে অন্তত ৫০-৫৫ কোটির টিকা প্রয়োজন।
কিন্তু প্রতিষেধক তো বাড়ন্ত। মডার্না বা ফাইজ়ারের মতো বিদেশি সংস্থাগুলির টিকা প্রথমত দামি এবং সেগুলির রক্ষণাবেক্ষণের পরিকাঠামো ভারতের হাতে নেই। দ্বিতীয়ত, ইউরোপ ও আমেরিকা ইতিমধ্যেই ওই সংস্থাগুলিকে অগ্রিম বরাত দিয়ে রেখেছে। স্বাস্থ্যকর্তাদের মতে, যথেষ্ট সংখ্যক প্রতিষেধক না থাকা সব দেশের কাছেই সমস্যার। তাই ভারতের বাজারে পাওয়া প্রতিষেধক দিয়েই ধাপে ধাপে এগোনোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। সরকারের প্রাথমিক লক্ষ্য হল, হু-এর হিসেব ধরে এগিয়ে ৩০ কোটি মানুষকে প্রথমে টিকা দেওয়া।
এখন স্বাস্থ্যকর্মীদের চিহ্নিত করা চলছে। কারা টিকা পেলেন, সেই বিষয়টিতে নজর রাখা হবে মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে। পরবর্তী ধাপে পুলিশ-আধাসেনার তথ্য সংগ্রহ করা হবে। তৃতীয় ধাপে চিহ্নিত় করা হবে ২৭ (২৬+১) কোটি দেশবাসীকে। রাজ্যগুলিকেই এই দায়িত্ব দেওয়া হবে। সূত্রের মতে, জনগণনার রিপোর্টের ভিত্তিতে যাঁদের বয়স পঞ্চাশের বেশি, যাঁদের কঠিন রোগ রয়েছে, তাঁরা কর্মরত না অবসরপ্রাপ্ত, দৈনন্দিন জীবনে সংক্রমণের সম্ভাবনা কতটা— এ সব বিচার করে চূড়ান্ত তালিকা করা হবে। আধার নম্বরের ভিত্তিতে দেখে নেওয়া হবে ওই ব্যক্তি সম্প্রতি করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন কি না। বয়স্কদের মধ্যে যাঁরা সংক্রমিত হয়ে সেরে উঠেছেন, তাঁদের প্রথমে বাদ রাখা হবে।
তবে স্বাস্থ্যকর্তাদের মতে, যেহেতু অ্যান্টিবডি কত দিন সক্রিয় থাকছে তা স্পষ্ট নয়, সেই কারণে তাঁদের একেবারে বাদ দেওয়া হচ্ছে না। পরে বাজারে যথেষ্ট প্রতিষেধক এলে তাঁদের টিকাকরণের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
কোন টিকা? মন্ত্রক সূত্রে ইঙ্গিত, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের কাছে যে সব বিকল্প রয়েছে, অক্সফোর্ডের কোভিশিল্ড তার অন্যতম, যা ভারতে উৎপাদনের দায়িত্বে রয়েছে পুণের সিরাম সংস্থা। সিরামের সিইও আদার পুনাওয়ালার দাবি, তাঁরা জানুয়ারির মধ্যে অন্তত দশ কোটি কোভিশিল্ড প্রতিষেধক উৎপাদন করতে সক্ষম হবেন, যার অর্ধেক ব্যবহার হবে ভারতে। এ ছাড়া রাশিয়ার ভ্যাকসিন স্পুটনিক ভি-র দ্বিতীয়/তৃতীয় পর্বের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ এ দেশে শুরু করেছে ভারতীয় সংস্থা রেড্ডিজ় ল্যাব। চুক্তি অনুযায়ী তাদের মাধ্যমে ১০ কোটি স্পুটনিক ভারতের বাজারে ছাড়া হবে বলে জানিয়েছে রাশিয়া।