চারু খুরানা
তাঁরা তো এ দেশেরই নাগরিক। তা হলে প্রাপ্য কিছু মৌলিক অধিকার থেকে কেন তাঁরা বঞ্চিত হবেন?
পরিযায়ী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের এই লড়াইটা বরাবরই ছিল। কিন্তু তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয় বছর কয়েক আগে। যখন মেকআপ আর্টিস্ট চারু খুরানাকে সদস্যপদ দিতে অস্বীকার করেছিল মুম্বইয়ের মেকআপ আর্টিস্ট ও হেয়ার ড্রেসারদের সংগঠন। যুক্তি ছিল, চারু মহিলা এবং তিনি মহারাষ্ট্রে পাঁচ বছর থাকেননি। তাই তাঁকে সদস্যপদ দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কেন তিনি সদস্যপদ পাবেন না, এই প্রশ্ন তুলে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন চারু। সুপ্রিম কোর্ট তাঁর পক্ষে রায় দেয়। জানায়, কাজের ক্ষেত্রে লিঙ্গপরিচয় ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কোথায় বাস করেন, তা দেখা সংশ্লিষ্ট নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকারকেই ক্ষুণ্ণ করা। ফলে চারুকে সংশ্লিষ্ট সংগঠনের সদস্যপদ দিতে হবে।
২০১৭ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে যখন সারা দেশের পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ‘দ্য ওয়ার্কিং গ্রুপ অন মাইগ্রেশন’ গঠন করে তার রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছিল, তখন মুখবন্ধেই ‘চারু খুরানা ভার্সেস ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া অ্যান্ড আদার্স’ মামলাটি উল্লেখ করা হয়। শুধু এটা বোঝানোর জন্য যে, কাউকে তাঁর বাসস্থানের নিরিখে বিচার করে কাজ না-দেওয়ার বিষয়টি অসাংবিধানিক। ভারতের যে কোনও নাগরিক যে কোনও জায়গায় বাধাহীন ভাবে যেতে পারেন, কাজ করতে পারেন। কিন্তু সেই তত্ত্বের সঙ্গে বাস্তবের তফাত যে আদতে কত, সেটাই প্রকাশ্যে এনেছে সার্স-কোভ-২ সংক্রমণ ও তার পরবর্তী সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা।
আরও পড়ুন: করোনা সংক্রমণে ফের রেকর্ড, মৃত্যুতেও
দিল্লির বাসিন্দা চারু বর্তমানে ‘সেলিব্রিটি মেক-আপ আর্টিস্ট’। বলিউড, হলিউডে তো বটেই, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র নোদী, আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামারও মেকআপ করেছেন। আর্থিক ও সামাজিক অবস্থানে পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে তাঁর অনেকটাই দূরত্ব। কিন্তু বর্তমান অবস্থা নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমাকে দীর্ঘদিন নিজের অধিকার আদায়ের জন্য লড়তে হয়েছিল। আজ যখন সকলের একসঙ্গে মহামারির বিরুদ্ধে লড়ার কথা, তখন কেন দেশ-রাজ্য আলাদা-আলাদা ভাগ করা হচ্ছে বুঝতে পারছি না। কেন সংশ্লিষ্ট রাজ্যই সেখানকার শ্রমিকদের দায়িত্ব নিচ্ছে না?"
আরও পড়ুন: পরিযায়ীদের কাজের জায়গায় ফেরাতে ট্রেন
পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কেন্দ্রের রিপোর্ট তৈরির জন্য গঠিত বিশেষজ্ঞ দলের এক সদস্যের কথায়, ‘‘এই সমস্যাকে শুধুই পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা হিসেবে দেখলে তার সমাধান করা যাবে না। কারণ, তা হলে সেই সমস্যাকে নির্দিষ্ট পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখা হবে।’’ তা হলে কী করা প্রয়োজন? দলের আর এক সদস্য ‘ইন্দিরা গাঁধী ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ’-এর অধ্যাপক এস চন্দ্রশেখরের মতে, ‘‘পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যাকে সমগ্র অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদের সমস্যা হিসেবে দেখা প্রয়োজন। একমাত্র তা হলেই তার সমাধান এবং তাঁদের ন্যূনতম আর্থিক নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হবে।’’
পরিযায়ী শ্রমিকদের কারণে সংক্রমণ বাড়ছে— সমাজের বড় অংশের মানুষের এমন মনোভাবেরও তীব্র বিরোধিতা করছেন অনেকে। ‘টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস’-এর ‘স্কুল অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড লেবার স্টাডিজ’-এর অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর আমন জগেশ্বর বোরকারের কথায়, ‘‘এই সংক্রমণ তো সমাজের উচ্চ স্তর থেকে, মানে প্রাথমিক ভাবে বিমানযাত্রার মাধ্যমে নীচের স্তরে ছড়িয়েছে। আর এখন আমরা পরিযায়ী শ্রমিকদের দায়ী করছি? ওঁরা তো শুধু টিকে থাকার লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন।’’
আর সেই লড়াইয়েই কখনও হাজার-হাজার শ্রমিক পায়ে হেঁটেই বাড়ির উদ্দেশে পাড়ি দিচ্ছেন কয়েকশো কিলোমিটার, হাঁটার ক্লান্তিতে শ্রান্ত হয়ে রেললাইনের শোয়ার পরে তাঁদের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে রেলের চাকা, কখনও মৃত মা-কে ঠেলে জাগিয়ে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা করছে একরত্তি শিশু। চারু বলছিলেন, ‘‘এই সমস্ত দৃশ্য দেখে বড্ড বেশি অসহায় লাগছে নিজেকে!’’
শুধু চারুই নন, পরিযায়ী শ্রমিকদের এই নগ্ন বিপন্নতার সামনে এই মুহূর্তে অসহায় লাগছে গোটা দেশকেও!