হতদরিদ্রদের পেটের ভাত কী করে আসবে? —ফাইল চিত্র।
লন্ডন থেকে অনির্বাণের ফেসবুক পোস্টটা দেখেই মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল। করোনার থাবায় আহত। বাড়িতে। ক্লান্ত, কিন্তু ভাল হচ্ছে। আমার পরিচিতদের মধ্যে অনির্বাণই প্রথম এই অতিমারীর ছোবল খেল।
এত দিন অঙ্কের আঘাতেই ‘কী হবে কী হবে’ এই আতঙ্কে রক্তচাপ বাড়িয়ে, রাত জেগে কাটিয়েছি। অনির্বাণ বাড়িতে ভাল হচ্ছে এই খবর কোথায় যেন একটা আশ্বাস এনে দিল। পরিসংখ্যানও কিন্তু আশ্বাসের কথাই বলছে। বিশ্বজুড়ে এখনও পর্যন্ত যে করোনা আক্রান্তদের মূল চিকিত্সা প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়েছে, তাঁদের ৮৪ শতাংশ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। মারা গিয়েছেন ১৬ শতাংশ। পাশাপাশি, আজ এই লেখার সময় পর্যন্ত ভারতে মোট ৭২৪ জন আক্রান্ত, মৃত ১৬ জন, সরকারি হিসেবে সুস্থ হয়ে ফিরেছেন ৬৭ জন। মোট আক্রান্তের হিসাবে মৃত্যুর হার ২ শতাংশ।
কিন্তু এই পরিসংখ্যান পড়তে হবে পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে। সামাজিক দুরত্ব কিন্তু সব দেশে ঠিক সময়ে মানা হয়নি। চিন প্রথম আক্রান্ত দেশ। সামলাতে তাই জীবন বেরিয়ে গিয়েছে। ট্রাম্প বাজারকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। লকডাউনে তিনি বিশ্বাসী নন। তাই হু চিন্তিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে। আমরাও কিন্তু সংক্রমণের প্রথম দিকেই আছি। তাই মৃত্যুর হার এই ২ শতাংশে আটকে রাখতে পারলে ভারত বিশ্বে জনস্বাস্থ্যে পথিকৃৎ হয়ে উঠবে।
আরও পড়ুন: তিন মাসের ইএমআই কি মকুব? সব ব্যাঙ্ক দেবে? রইল সব প্রশ্নের উত্তর
কিন্তু বেকারের সংখ্যাও তাল মিলিয়ে বাড়ছে আমেরিকায়। আমাদের দেশে সরকারের নির্দেশে আমরা গৃহবন্দি। ওখানে অতিমারীর বিষ ছড়াচ্ছে বাজারে। বন্ধ হচ্ছে একের পর এক ছোট ব্যবসা। আমাদের এখানে কী হবে? করোনার থেকেও এই আশঙ্কা এখন অনেক বড় হয়ে উঠছে। লকডাউন না হলে, মার্কিন পথেই নাকি আমাদের অতিমারীর ছোবল তীব্র হত। লকডাউনের পরে চিত্রটা কতটা বদলাবে তা এখনই বলা সম্ভব নয়। কিন্তু বেকারের সংখ্যা যে হু হু করে বাড়বে তা নিয়ে সংশয় না রাখাই ভাল— মার্কিন পথেই।
মাথায় রাখতে হবে, প্রাথমিক কোপে আক্রান্ত দেশগুলিতে আর্থিক এবং পরিকাঠামোগত শক্তি ভারতের থেকে অনেক বেশি ছিল। তাই প্রধানমন্ত্রী, এই অতিমারীর অতি আক্রমণ সামলানো যে আমাদের মতো দেশের পক্ষে প্রায় অসম্ভব তা মেনে নিয়েই পর্যায়ক্রমে লকডাউন করেছেন। আর গতকাল ও আজ অর্থমন্ত্রী ও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এই অবস্থায় আমাদের জন্য কিছুটা শ্বাস ফেলার ব্যবস্থা করতে চেয়েছেন।
অসহায়ের এটাই স্বাভাবিক ও সাধারণ প্রত্যাঘাত। বাড়িতে আটকে থাকলে বাজারের চাকাও আটকে থাকবে। সাধারণ ‘দিন আনি দিন খাই’ মানুষের আয় লকডাউন-এ বন্ধ। তাই অর্থমন্ত্রী তাঁদের জন্য আয়ের স্তরভেদে নানান সুবিধার কথা ঘোষণা করেছেন। উল্লেখ করতেই হবে যে, এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু কেন্দ্রের আগেই প্রায় এক জাতীয় সুবিধা ঘোষণা করেছে।
যাঁরা সরকারি অবসরভাতার সুবিধা পান না, তাঁদের উপর এই কঠিন সময়ে আরও কঠিন আঘাত হানবে।—ফাইল চিত্র।
লকডাউনের কারণে সাধারণের কাছে মূল সমস্যাটা কী? হাতে টাকার টান। রান্নাঘরে টান রসদের। এই দুই সমস্যা আর্থিক স্তরভেদে আনুপাতিক গভীরতায় মধ্যবিত্ত থেকে হতদরিদ্রকে তাড়িয়ে ফিরছে। যাঁদের ঋণ আছে, তাঁরা ইএমআই দেবেন কী ভাবে? রোজগার যদি আগামী তিন মাস না থাকে আগের মতো? হতদরিদ্রদের পেটের ভাত কী করে আসবে?
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও অর্থমন্ত্রকের নীতিনির্দেশকে যদি এক জায়গায় করে দেখি, তা হলে তার অভিমুখ দাঁড়ায় এ রকম— বাস্তবকে স্বীকার করে নিয়ে, গৃহবন্দি নাগরিকের জীবন যতটা পারা যায় সহজ করে তোলা। আর তা করতে অতি দরিদ্রদের হাতে নগদ, আর রান্নাঘরে চাল ও ডাল পৌঁছে দেওয়া। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে ঋণের উপর সুদ কমানো এবং আগামী তিন মাস কেউ যদি ইএমআই দিতে না পারেন, তা হলে তাঁর উপর কোনও চাপ আসবে ন— মোরাটোরিয়াম। সরকারের ঘরে নাগরিকের দায়ের ক্ষেত্রেও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও অর্থমন্ত্রক নানান ছাড় দিয়েছে। আজ যে দায় মেটানোর কথা, তা প্রায় সব ক্ষেত্রেই জুন পর্যন্ত শিথিল করা হয়েছে।
কিন্তু যা পরিষ্কার নয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঘোষণা থেকে, তা হল এই মোরাটরিয়মের চরিত্র। এটা বোঝা গেল যে যদি আগামী তিন মাস কেউ কখনও তাঁর ইএমআই মেটাতে না-পারলে তা দোষের হবে না। ক্রেডিট রেটিং কমবে না। ঋণ খেলাপ হিসাবে ধরা হবে না। কিন্তু তার সুদ? সাধারণ ভাবে এই ধরনের মোরাটরিয়মে এ সব ক্ষেত্রে বকেয়ার উপর একটা সুদ ধরা হয়, সাধারণ হারে। এ ক্ষেত্রে কী হবে তার কোনও দিশা এই লেখা পর্যন্ত কিন্তু মেলেনি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছ থেকে। জানা যায়নি ক্রেডিট কার্ডের ঋণের ক্ষেত্রে কী হবে।
আরও পড়ুন: গরিবদের জন্য ত্রাণ নির্মলার, বরাদ্দ ১.৭০ লক্ষ কোটি
এর চাপ কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত বিশেষ করে যাঁরা সরকারি অবসরভাতার সুবিধা পান না, তাঁদের উপর এই কঠিন সময়ে আরও কঠিন আঘাত হানবে। সাত শতাংশ সুদ পেলে, বর্তমান হারে তা হবে ছয় শতাংশের আশেপাশে। না। চলতি আমানতের উপর চাপ নেই। কিন্তু যদি আমানতের মেয়াদ শেষ হয়ে যায় এবং নতুন করে করতে হয় তাহলে লাখে হাজার টাকা আয় কমবে আপনার।
অর্থাৎ এক কথায় নীতিগত ভাবে এই দুঃসময়ে সরকার আপনাকে গৃহবন্দি করে দিলেও আর্থিক ও সামাজিক ভাবে আপনার পাশেই আছে তাই বোঝাতে চাইছেন! কিন্তু আপনি কী দেখছেন? কাল এক পরিচিতের ফোনে জানলাম তাঁর দুই পিসি ৭৫ পেরিয়েছেন, থাকেন সেই পরিচিতের থেকে সাত কিমি দুরে। বাড়িতে রসদ নেই। কী করবেন? সরকার বলছেন অনলাইন পরিষেবার সাহায্য নিতে। এই পরিচিতটিও চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। ওই দুই বৃদ্ধার কাছে ওষুধও তলানিতে!
ডেলিবাজারের অভিরূপ বসাক হাত তুলে দিয়েছেন। রসদ জোগাড় করতে পারছেন। কিন্তু পৌঁছবেন কার হাত দিয়ে? তাঁর সহায়করা প্রধানমন্ত্রীর উচ্চারণ, “জান হায় তো জাহান হ্যায়”, তুলে কাজে আসতে অস্বীকার করছেন। স্থানীয়দের নিয়ে নতুন করে নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে পরিষেবা তৈরি করতে চাইছেন তিনি। কিন্তু তাতে উপকৃত হবেন বহুতলের মানুষ। যে দুই বৃদ্ধার কথা লিখলাম অভিরূপের এই পদক্ষেপে তাঁদের তো কোনও উপকার হবে না।
আর সমস্যাটা ঠিক এইখানেই। প্রধানমন্ত্রী যখন প্রথম আমাদের স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি থাকার পরামর্শ দেন, তখন তিনি যে চিত্রটা এঁকেছিলেন তা বেশ ভয়ের। স্পেন, ইটালি ও মার্কিন আক্রান্তের অঙ্কও বলে যে মোদী ঠিকই করেছিলেন। জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা আমাদের বেশ ভঙ্গুর। স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যায় হ্যাজমাট স্যুট পর্যন্ত নেই।
চক্রব্যূহ। আমরাও অভিমন্যুর মতো করোনাবৃত্তে ঢুকতেই পেরেছি। কিন্তু কী ভাবে বেরোব তার ঠিকানা না থাকায় চালু অস্ত্রেই প্রত্যাঘাত করে চলেছি বাঁচার আশায়। সামাজিক দুরত্ব বা গতকাল ও আজকের ছাড়। কিন্তু আরও বড় সমস্যা তৈরি হয়েছে রসদ ও ওষুধের সরবরাহ নিয়ে। সরকার যদি দ্রুত এই সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করতে না-পারেন তা হলে এই ‘কারফিউ’ ধরে রাখা যাবে না। আটকানো যাবে না আক্রান্তের স্রোতও। এখনও পর্যন্ত করা পদক্ষেপগুলি শক্ত কিন্তু সাধারণই। প্রশাসনিক দক্ষতার পরীক্ষা কিন্তু এই সরবরাহ ব্যবস্থা। এর কিন্তু কোনও নির্দিষ্ট ও সঠিক প্রতিফলন এখনও দৃশ্য নয়।