ছবি: পিটিআই।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান। দেশ জুড়ে আজ ‘জরুরি ভিত্তিতে’ করোনার প্রতিষেধক দেওয়ার অভিযান শুরু হল। তবে প্রথম দিনেই প্রতিষেধক দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। স্বাস্থ্য মন্ত্রক সরকারি ভাবে এ নিয়ে কোনও ব্যাখ্যা দেয়নি। তবে ঘরোয়া আলোচনায় দু’টি প্রতিষেধকের মধ্যে ভারতে তৈরি কোভ্যাক্সিন-কে ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্ককেই এর কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
আজ সকাল সাড়ে ১০টায় দেশ জুড়ে প্রতিষেধক অভিযানের সূচনা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রথম পর্বে ৩০ কোটির মধ্যে এক কোটি স্বাস্থ্যকর্মীকে ভ্যাকসিন দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে কেন্দ্রের। লক্ষ্যমাত্রা ছিল, প্রথম দিন প্রায় তিন লক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীকে প্রতিষেধক দেওয়া হবে। কিন্তু দিনের শেষে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অতিরিক্ত সচিব মনোহর আগনানি জানান, দেশের ৩৩৫১টি কেন্দ্রে মোট ১,৯১,১৮১ জন প্রতিষেধক নিয়েছেন। এ দিন প্রতিষেধক দেওয়ার অভিযানে ছিলেন মোট ১৬,৭৫৫ জন। আগনানি বলেন, “আজ মূলত হায়দরাবাদে তৈরি ভারত বায়োটেক সংস্থার কোভ্যাক্সিন এবং অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজ়েনেকা সংস্থার তৈরি কোভিশিল্ড এই দু’টি প্রতিষেধক প্রয়োগ করা হয়েছে। ১২টি রাজ্যে দু’ধরনেরই প্রতিষেধক ব্যবহার করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ-সহ বাকি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে কেবল কোভিশিল্ড ব্যবহার করা হয়েছে।” স্বাস্থ্য মন্ত্রকের হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের ১৮৩টি টিকাকেন্দ্র মোট ৯৫৮২ জন প্রতিষেধক নিয়েছেন।
আগনানির দাবি, দেশে প্রথম দিনের অভিযান সফল হয়েছে। কিন্তু প্রথম দিনেই যে লক্ষ্যের চেয়ে ১.১ লক্ষ কম সংখ্যক মানুষ প্রতিষেধক নিলেন! সন্ধের সাংবাদিক বৈঠকে এর কোনও ব্যাখ্যা দেননি আগনানি। শুধু তথ্য-পরিসংখ্যান সম্বলিত বিবৃতি পাঠ করেই উঠে চলে যান স্বাস্থ্য মন্ত্রকের এই শীর্ষ কর্তা। সন্ধেয় আগনানি জানান, করোনা প্রতিষেধক দান সংক্রান্ত সরকারি অ্যাপ ‘কোইউন’-এ তথ্য আপলোড করার ক্ষেত্রে আজ কিছু সমস্যা হয়েছিল। পরে সমস্যা মিটিয়ে ফেলা গিয়েছে। যদিও রাতে সংবাদ সংস্থা জানায়, ওই অ্যাপের সফটওয়্যারে সমস্যার জন্য মহারাষ্ট্রে সোমবার পর্যন্ত প্রতিষেধক অভিযান বন্ধ রাখতে হয়েছে।
আরও পড়ুন: দেশের প্রথম টিকা পেলেন এমসের এক সাফাই কর্মী
আরও পড়ুন: বালাকোটের আগেই ‘পূর্বাভাস’ অর্ণবের
তবে স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশ ঘরোয়া ভাবে বলছেন, এর জন্য দায়ী কোভ্যাক্সিন-বিতর্ক। যা স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে এই প্রতিষেধক নেওয়া নিয়ে দ্বিধা সৃষ্টি করেছে। অনেকেই প্রথমে সম্মতি জানিয়েও পরে পিছিয়ে গিয়েছেন। অনেক চিকিৎসক হাজির হননি কেন্দ্রে। বিশেষ করে যে ১২টি রাজ্যে দু’ধরনের প্রতিষেধক ব্যবহার হচ্ছে, সেখানে অনেকেই কোভ্যাক্সিন প্রতিষেধক দেওয়া হচ্ছে শুনে পিছিয়ে আসেন।
প্রতিষেধক নেওয়া বাধ্যতামূলক না-হওয়ায় জোরও খাটাতে পারছে না সরকার। এক স্বাস্থ্যকর্তা বলেন, ‘‘টিকাকরণ শুরুর এক ঘণ্টার মধ্যে দিল্লির রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালের চিকিৎসকেরা কোভ্যাক্সিন দেওয়া নিয়ে আপত্তি জানিয়ে সরব হন। এমনিতেই ওই প্রতিষেধকের নিরাপত্তা ও তার কার্যকারিতা নিয়ে মানুষের মনে সংশয় ছিল। এর পর দিল্লির একটি সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা এ ভাবে বেঁকে বসায় সার্বিক টিকাকরণ অভিযানে তার প্রভাব পড়ে।
তবে সরকারের অন্য একটি অংশের মতে, যে কোনও অভিযানের প্রথম দিনে কিছু সমস্যা দেখা যায়। প্রতিটি কেন্দ্রে দিনে ১০০ জনকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হলেও তা বাস্তবে কতটা সম্ভব, সেই পরীক্ষাও আজ হয়ে গেল। ভবিষ্যতে প্রতি দিনের প্রতিষেধক প্রাপকের সংখ্যা আরও বাড়বে বলেই আশা করছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। প্রতিষেধক নেওয়ার পরে দিল্লিতে ৫১ জন স্বাস্থ্যকর্মীর জ্বর ও অ্যালার্জির মতো সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এ দিন। তবে কাউকেই হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়নি।
এই পরিস্থিতিতে প্রতিষেধক সংক্রান্ত কোনও অপপ্রচারে কান না-দেওয়ার অনুরোধ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি বলেন, ‘‘প্রতিষেধকগুলির সুরক্ষা ও কার্যকারিতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়ার পরেই বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা জরুরি ভিত্তিতে সেগুলি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন। তাই সমস্ত ধরনের গুজব, ভুল তথ্য ও বিভ্রান্তিকর প্রচার থেকে দূরে থাকুন।” আজ যাঁরা প্রতিষেধক নিলেন, ২৮ দিন পরে অবশ্যই তাঁদের প্রত্যেককে একই প্রতিষেধকের দ্বিতীয় ডোজ় নিতে হবে, সে কথাও মনে করিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী নিজে বা মন্ত্রিসভার কোনও শীর্ষ নেতা কেন আজ প্রতিষেধক নিলেন না এই প্রশ্ন তুলেছেন কংগ্রেসের মণীশ তিওয়ারি। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সকলের আগে ভ্যাকসিন নিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপ্রধানরা প্রতিষেধক নিলে দেশবাসীর কাছে বার্তা যায় যে, সেটি নিরাপদ। কিন্তু ভারতে প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রিসভার কেউ প্রতিষেধক না-নেওয়ায় জনমানসে তার নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।” তাঁর দাবি, কোভ্যাক্সিনের ছাড়পত্র নিয়ে সমস্যা থাকায় প্রতিষেধক প্রাপকদের নিজস্ব প্রতিষেধক বেছে নেওয়ার অধিকার দেওয়া হোক। বিশেষ করে যেখানে জরুরি ভিত্তিতে ছাড়পত্র দেওয়ার নিজস্ব কোনও নীতি নেই ভারতের। যদিও স্বাস্থ্য মন্ত্রক আজ ফের জানিয়েছে, কেন্দ্রে যে প্রতিষেধক পৌঁছেছে, তাঁর ভিত্তিতেই অভিযান চলবে। প্রতিষেধক বেছে নেওয়ার সুযোগ প্রাপকদের কছে থাকবে না।