Coronavirus in India

প্রতিষেধক নিখরচায় নয় কেন, প্রশ্নে কেন্দ্র

উন্নত দুনিয়ায় সস্তার টিকা সরবরাহের কূটনীতিতে সাফল্যের গর্ব করা দেশ, নিজের গরিব-গুর্বোদের নিখরচার প্রতিষেধকের দায়িত্ব নিতে পারে না?

Advertisement

সায়ন্তনী ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২১ ০৫:০৬
Share:

প্রতীকী ছবি।

তিন কোটি স্বাস্থ্যকর্মী ও অগ্রবর্তী (ফ্রন্টলাইন) যোদ্ধাকে নিখরচার প্রতিষেধক জুগিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম টিকাকরণ কর্মসূচি শুরুর কথা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করেছিল নরেন্দ্র মোদী সরকার। গাঁটের কড়ি গুনে বেসরকারি হাসপাতাল কিংবা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রতিষেধক নেওয়ার রাস্তা খুলে দিলেও বিনা পয়সায় টিকা পাওয়ার পথ খোলা ছিল কোমর্বিডিটি থাকা ৪৫-ঊর্ধ্বদের জন্যও। কিন্তু ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সিদের জন্য নিখরচায় প্রতিষেধক দেওয়ার কথা অন্তত এখনও পর্যন্ত বলেনি কেন্দ্র। এ পর্যন্ত যা ইঙ্গিত, তাতে হয় সংশ্লিষ্ট রাজ্য নিজেরা কিনে তাঁদের বিনা পয়সায় তা দেবে, আর নয়তো কমবয়সিদের টিকা নিতে হবে টাকা গুনে। প্রশ্ন উঠছে, ইউরোপের প্রায় সব দেশ, ব্রাজ়িল কিংবা পড়শি বাংলাদেশ যেখানে নিখরচায় সকলকে প্রতিষেধক দিচ্ছে, সেখানে কোন যুক্তিতে সেই দায়িত্ব থেকে হাত গুটিয়ে নিচ্ছেন মোদী?

Advertisement

চিকিৎসক মহলের এক বড় অংশের প্রশ্ন, উন্নত দুনিয়ায় সস্তার টিকা সরবরাহের কূটনীতিতে সাফল্যের গর্ব করা দেশ, নিজের গরিব-গুর্বোদের নিখরচার প্রতিষেধকের দায়িত্ব নিতে পারে না? যে দেশ জনসংখ্যায় কমবয়সিদের প্রাধান্যকে অন্যতম শক্তি হিসেবে তুলে ধরে, সেখানে তাঁরাই টিকা-অভিযানে ব্রাত্য? এর আগে স্মল পক্স থেকে শুরু করে পোলিয়ো পর্যন্ত বিভিন্ন অসুখের প্রতিষেধক যদি নিখরচায় ঘরে-ঘরে দেওয়া সম্ভব হয়ে থাকে, তাহলে কোভিডের বেলায় তা সম্ভব হল না কেন? রাজ্যগুলির ঘাড়ে প্রতিষেধক কেনার বিপুল খরচ চাপিয়ে দেওয়া নিয়ে ইতিমধ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন রাজ্য। সেই সঙ্গে ঘুরপাক খাচ্ছে প্রশ্ন, সংস্থার সামনে বহু গুণ দরে টিকা বিক্রির সুযোগ থাকলে, তারা যথেষ্ট সংখ্যায় সরকারকে আর বিক্রি করবে কি? এর পরে প্রতিষেধক নিয়ে কালোবাজারি শুরু হলেই বা তার দায় নেবে কে?

প্রতিষেধক যে নিখরচায় দেওয়া হবে না, এখনও সরকারি ভাবে তা ঘোষণা করেনি কেন্দ্র। কিন্তু তেমনই দেওয়ার কথাও উচ্চারণ করেনি তারা। এই ধোঁয়াশার দরুন যে দেরি হবে, অতিমারিতে রাশ টানায় তা অন্যতম বাধা হতে পারে বলে জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকদের একাংশের আশঙ্কা। তাঁদের মতে, ‘‘এখন লক্ষ্য, দ্রুত গণটিকাকরণ। নইলে ভাইরাসকে হারানো অসম্ভব। কিন্তু এখন টাকার অভাবে যদি দেশবাসীর একাংশ টিকা নিতেই না-পারেন, সে ক্ষেত্রে কী করে তা কাবু হবে, সেই প্রশ্ন থাকছে।’’ একই সঙ্গে তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘ইন্দিরা গাঁধী, মনমোহন সিংহের সরকার যদি স্মল পক্স বা পোলিয়োর টিকা ঘরে-ঘরে বিনামূল্যে পৌঁছে না-দিত, তা হলে এখনও সেই সব রোগ জাঁকিয়ে বসে থাকত ভারতে।’’

Advertisement

দেশে আপাতত দু’টি প্রতিষেধক দেওয়া হচ্ছে। কোভ্যাক্সিন ও কোভিশিল্ড। বেসরকারি হাসপাতালের কোভ্যাক্সিনের প্রতি ডোজ় কেনার কথা ১,২০০ টাকায়। রাজ্য ৬০০ টাকায়। অথচ এই ভ্যাকসিন তৈরিতে যুক্ত ছিল সরকারি প্রতিষ্ঠান আইসিএমআর-এনআইভি। গবেষণায় মিলেছিল সরকারি অনুদানও। অর্থাৎ, সাধারণ মানুষের দেওয়া করের টাকা ভ্যাকসিন তৈরিতে খরচ হওয়া সত্ত্বেও তা কিনতে হবে চড়া দামে! এক বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘বাজার আপনি করেছেন। এ বার তা দিয়ে রান্না করা খাবারও কিনে খেতে হবে!’’

এ দিন পুণের সিরাম ইনস্টিটিউটের সিইও আদার পুনাওয়ালাকে ‘ওয়াই ক্যাটেগরি’ নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে। অ্যাস্ট্রাজ়েনেকার টিকা কোভিশিল্ড এ দেশে তৈরি করছে ওই সংস্থা। এত দিন দর ছিল ১৫০ টাকা। লাফিয়ে দাম বাড়ছে তারও। দেখা যাচ্ছে, অন্য বহু দেশের তুলনায় ভারতেই এই টিকা বেশি দরে বিক্রি করবে তারা। সমালোচনার ঝড় উঠেছে এ নিয়ে। চিকিৎসক পুণ্যব্রত গুণের কথায়, ‘‘চাইলেই সরকার এই ভার নিতে পারে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর তো আমজনতা কম গোনেন না।’’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিশেষজ্ঞ-চিকিৎসক এক ধাপ এগিয়ে বলছেন, ‘‘কোটি কোটি টাকা দিয়ে মূর্তি বা স্টেডিয়াম তৈরি না-করে, সে টাকা তো জনস্বাস্থ্যে ব্যয় করা যেত!’’

চিকিৎসক শান্তনু ত্রিপাঠীর অবশ্য বক্তব্য, ‘‘যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁরা দাম দিয়েই কিনুন। নইলে ১৩৮ কোটির দেশে সরকারের পক্ষ থেকে সবটা সামলানো হয়তো কষ্টকর।’’ তাঁর বিশ্বাস, সরকারি হাসপাতালে নিম্নবিত্তদের বিনামূল্যে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। তেমনই অনেকে আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সেন্ট্রাল ভিস্টায় যে ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে, শুধু তা দিয়েই কত কোটিকে টিকা দিতে পারত কেন্দ্র।

চিকিৎসক শিবিরের একাংশের আশঙ্কা, বেসরকারি হাতে টিকা গেলে কালোবাজারির আশঙ্কা থাকবে। এই আশঙ্কায় টিকাকরণের রাশ নিজেদের হাতে রেখেছে বহু দেশের সরকার। ভারতের থেকে প্রতিষেধক কেনা বহু দেশ সকলকে টিকা জোগাচ্ছে নিখরচায়। অস্ট্রেলিয়ায় প্রত্যেক বাসিন্দার মেডিক্যাল কার্ড রয়েছে। তা দেখালেই মিলবে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলিতে এটি আইন। নাগরিক হোন বা না-হোন, বাসিন্দা হলেই বিনামূল্যে টিকা। আমেরিকা-কানাডাতেও সরকার বিনামূল্যে টিকা দিচ্ছে। যে ব্রাজ়িলে করোনার ব্যাপক সংক্রমণের জন্য প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারোকে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে, সেখানেও বিনামূল্যে টিকাকরণের ব্যবস্থা! সে দেশের বাসিন্দা অনাবাসী ভারতীয় চৈতালি চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এখানে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা বিনামূল্যে মেলে। চাইলে কেউ বেসরকারিতে যেতে পারেন। কিন্তু কালোবাজারি আটকাতে কোভিডের টিকাকরণ সরকারি হাতেই রাখা হয়েছে।’’ বাংলাদেশের নাগরিক রাশেদুল সরকার বলেন, ‘‘এ পর্যন্ত যত জনকে টিকা দেওয়া হয়েছে, টাকা লাগেনি।’’ বিশ্বে সব চেয়ে দ্রুত টিকাকরণ চলছে ইজ়রায়েলে। প্রাপ্তবয়স্কদের ৮১ শতাংশের টিকাকরণ শেষ। আর হ্যাঁ, সেখানেও টিকা সম্পূর্ণ ‘ফ্রি’।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement