অদ্ভুত সমাপতন। তারিখ একই। মাঝে শুধু ৬০ দিনের ব্যবধান।
জানুয়ারির ২০ তারিখের তথ্য নিয়েই নোভেল করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯-এর প্রথম ‘সিচুয়েশন রিপোর্ট’-টি প্রকাশ করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। রিপোর্টে চিন-সহ আরও তিনটি, অর্থাৎ মোট চারটি দেশে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৮২। তার ঠিক দু’মাস পরে, শুক্রবার ২০ মার্চ, যে দিন ঘটনাচক্রে ‘আন্তর্জাতিক সুখ দিবস’ও (ইন্টারন্যাশনাল হ্যাপিনেস ডে), সে দিন করোনা আক্রান্ত দেশ-অঞ্চলের সংখ্যা ১৮৩। করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় দু’লক্ষ ৬৫ হাজার। মৃতের সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে।
তথ্য বলছে, দু’মাসে প্রতিদিন গড়ে চার হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। বিশ্বের কোনও দেশ-অঞ্চলই আর নিরাপদ নয়, মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। সেই পরিস্থিতিতে শুধু শহর বা দেশই কেন, সারা বিশ্বের সুখের সংজ্ঞাই বদলে গিয়েছে বলে জানাচ্ছেন তাঁরা। নোভেল করোনাভাইরাস নিয়ে কাজ করা এক গবেষকের কথায়, ‘‘বেঁচে থাকার প্রবৃত্তির (সার্ভাইভাল ইনস্টিংক্ট) কারণে পাশের জনের কাছ থেকে সংক্রমিত হব কি না, এই চিন্তাই এখন প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। আড্ডা, কেনাকাটা, একসঙ্গে খেতে যাওয়ায় আমাদের জীবনের ছোট ছোট খুশি-আনন্দ। সেই সব ক্ষেত্রে এখন আতঙ্ক, অবিশ্বাস আর সংশয়ের ছায়া।’’
আয়ু, সামাজিক সহায়তা, আয়, স্বাধীনতা, আস্থা, স্বাস্থ্য-সহ একাধিক সম্মিলিত বিষয়ের ফল হল আনন্দ বা সুখ-সূচক। এই সূচকের উপরে নির্ভর করে প্রতি বছর রাষ্ট্রপুঞ্জেরই একটি সংস্থা ‘সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশন নেটওয়ার্ক’ সংশ্লিষ্ট রিপোর্টটি প্রকাশ করে। গত আট বছর ধরে সেই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। চলতি বছরের রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, ভারত গত বছরের তুলনায় চার ধাপ নেমেছে। ২০১৯ সালে ভারতের স্থান ছিল ১৪০, চলতি বছরে ১৪৪। গত কয়েক বছর ধরেই ভারতের এই অধোগমন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক পঞ্চানন দাস জানাচ্ছেন, অনেকগুলি বিষয়ের মিলিত ফল হল সুখ-সূচক। বর্তমান পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বেই এই সূচক তলানিতে। কারণ, আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বোঝা যাবে আতঙ্কের রেশ কাটার পরেই। পঞ্চাননবাবুর কথায়, ‘‘যাঁরা আর্থিক ভাবে লড়তে পারছেন, তাঁরা লড়ছেন। কিন্তু শহরের বড় অংশের মানুষের রোজগার দিনভিত্তিক। খুশি-আনন্দের অন্যতম মাপকাঠিই হল আয়। সেটাই যখন বিপন্ন, তখন আনন্দ থাকবে কী ভাবে!’’
সমাজতত্ত্বের গবেষকদের একটি অংশ জানাচ্ছেন, নাগরিকত্ব হারানোর ভয়, দিল্লির গন্ডগোল, অশান্ত পরিবেশ— সব মিলিয়ে নাগরিকদের একটি বড় অংশের উপরে এত দিন ধরে অস্বাভাবিক চাপ চলেছে। তার পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে যাঁরা সরাসরি ঘটনাগুলির সঙ্গে যুক্ত নন, তাঁদের উপরেও। কিন্তু কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ সেই সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক, বলছেন তাঁরা। কারণ, যখন পাশের জন, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবের থেকেও সচেতন ভাবে দূরত্ব বজায় রাখতে হয়, তখন কোনও ভাবেই জীবন আগের ছন্দে চলে না। এক গবেষক জানাচ্ছেন, যে বন্ধুর হাত এত দিন অবলীলায় ধরা যেত বা যার সঙ্গে খাবার ভাগ করে খাওয়া যেত, এখন তেমন কিছু করার আগে দু’বার ভাবতে হচ্ছে। মানে কারও স্বতঃস্ফূর্ত জীবনের যে ছন্দ, তার উপরে সচেতন ভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করতে হচ্ছে। ওই গবেষকের কথায়, ‘‘তাত্ত্বিক দিকটি বাদ দিলে সাধারণ মানুষের কাছে আনন্দ-খুশির যে ধারণা, সেই সব ক্ষেত্রে এখন লক্ষ্মণরেখা টানা। সুখ থাকবে কী ভাবে!’’
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক প্রদীপ বসু জানাচ্ছেন, শাহিন বাগ, পার্ক সার্কাস-সহ দেশের নানা জায়গায় এত দিন ধরে নাগরিকত্ব হারানোর ভয়ে প্রতিবাদ চলছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রতিবাদ কী ভাবে চালানো যাবে, বয়স্ক প্রতিবাদকারীরা সংক্রমিত হলে কী হবে, এমন অনেক কথাই ভাবতে হচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘দিনের শেষে শুধু অচেনা ভয়ই কাজ করছে মনে। সকলে একটি জিনিসই চাইছেন যত দ্রুত এই বিপদ যেন কেটে যায়।’’
কিন্তু সেটা কবে কাটবে, জানেন না কেউই। ফলে বর্তমানের জন্য শুধু আতঙ্ক, সংশয়ই রইল।— ‘আন্তর্জাতিক সুখের দিনে’-ও!