গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
স্বয়ং সনিয়া গান্ধীর ‘ইচ্ছাতেই’ কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনে লড়তে নেমেছেন তিনি। কংগ্রেসের একটি সূত্রের মতে, অসমের দলীয় নেতাদের কাছে ভোটের আবেদন জানাতে গিয়ে এই দাবি করেছেন মল্লিকার্জুন খড়্গে। আরও বলেছেন, তিনি সনিয়ার কাছে কংগ্রেস সভাপতি পদের জন্য দু’তিনটি নাম দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সনিয়া তাঁকে বলেন, অন্য কারও নাম নয়। তিনি খড়্গেকেই চান! শুধু সনিয়া নন, গোটা গান্ধী পরিবারের ‘হাত’ এই প্রবীণ রাজনীতিকের মাথাতেই রয়েছে বলেই ইতিমধ্যেই ‘বার্তা’ রটে গিয়েছে কংগ্রেসের অন্দরে। যা লড়াই শুরুর আগেই পিছিয়ে দিয়েছে শশী তারুরকে। যদিও মঙ্গলবার এই সম্পূর্ণ বিষয়টিকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন খড়্গে। তিনি বলেন, ‘কংগ্রেস পার্টি, সনিয়া গান্ধী এবং তাঁকে বদনাম করার জন্য এই গুজব ছড়ানো হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সনিয়া গান্ধী সভাপতি পদের জন্য আমার নাম প্রস্তাব করেছেন, পুরোটাই গুজব, আমি কখনই তা বলিনি। তিনি স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছিলেন যে, গান্ধী পরিবারের কেউ নির্বাচনে অংশ নেবেন না বা কোনও প্রার্থীকে সমর্থন করবেন না।’
অথচ দেড় দশক আগে এআইসিসির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণের পরে রাহুল গান্ধী দলের অন্দরে যে ‘নতুন রক্তসঞ্চারের’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ৮০ বছরের খড়্গের তুলনায় ৬৬ বছরের তারুর তা পালনের জন্য অনেক বেশি মানানসই। নতুন প্রজন্মের ভোটারদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তার প্রমাণ মেলে সামাজিক মাধ্যমে ‘ফলোয়ার’-এর সংখ্যায়। কিন্তু এআইসিসির প্রতিনিধি তালিকায় (আগামী ১৭ অক্টোবর যাঁরা কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচন করবেন) সেই প্রজন্মের প্রতিনিধির সংখ্যা হাতেগোনা। যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের বড় অংশও আবার ‘পারিবারিক ঐতিহ্য’ অনুসরণ করেই পা রেখেছেন কংগ্রেস রাজনীতিতে। তারুরের মতো ‘বহিরাগত’ নন। ফলে ভোটের ফলাফল কার্যক্ষেত্রে ‘নির্ধারিত’ বলেই মনে করা হচ্ছে।
যোগ্যতার নিরিখে তারুরকে এগিয়ে রাখছেন কংগ্রেস নেতাদের অনেকেই। ফাইল চিত্র।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন পেশের পরে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী সম্পর্কে তারুর বলেছিলেন, ‘‘মল্লিকার্জুন খড়্গে’জি কংগ্রেসের ভীষ্ম পিতামহ। তাঁর মনোনয়ন জমা দেওয়াকে স্বাগত। কিন্তু দলে গণতন্ত্রের স্বার্থেই একাধিক প্রার্থীর প্রয়োজন।’’ লড়াইয়ের পরিণতি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই কি ‘কুরুবংশের’ প্রতি বৃদ্ধ পিতামহের আনুগত্যের প্রসঙ্গ তুলে কংগ্রেসের ‘শাসক পরিবারকে’ খোঁচা দিতে চেয়েছিলেন শশী?
কংগ্রেসের অন্দরের খবর সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নেতানেত্রীদের একাংশ মনে করেন, তারুরের ‘দক্ষতা’ এবং ‘পরিচিতি’ই কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনের ময়দানে তাঁর প্রধান অন্তরায়। সুদর্শন, সুবক্তা, সুলেখক তো বটেই, তরুণ প্রজন্মের কাছে তারুর অনেকটা ‘খোলা হাওয়া’র মতো। কংগ্রেসের অন্দরের খবর, মূলত সেই কারণেই কংগ্রেস সভাপতির পদে এক পরিচিত তারুরের নাম তোলা মাত্রই তা নাকচ করে দিয়েছিলেন রাহুল! শোনা যায়, তিনি বলেছিলেন, ওই পদের জন্য প্রবীণ, অভিজ্ঞ এবং পোড়খাওয়া রাজনীতিকের প্রয়োজন। তবে নিন্দকেরা বলছেন, ১০ জনপথের নাকি উদ্বেগ ছিল, তারুর যদি জনপ্রিয়তার কারণে নতুন ‘ক্ষমতাকেন্দ্র’ হয়ে ওঠেন! যদিও এই বক্তব্যের কোনও আনুষ্ঠানিক সত্যতা মেলেনি। অবশ্য এ ধরনের পছন্দ-অপছন্দের ‘আনুষ্ঠানিক’ সমর্থন বা বিরোধিতা রাজনীতিতে কখনও মেলেও না।
তবে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনে খড়্গের প্রতিদ্বন্দ্বী তারুরও দাবি করেছেন, সনিয়ার ‘সবুজ সঙ্কেত’ পেয়ে রাহুল গান্ধীর ‘মনোবাঞ্ছা’ পূরণের জন্যই তিনি ১৩৬ বছরের রাজনৈতিক দলের শীর্ষপদের জন্য ভোটের লড়াইয়ে নেমেছেন। কিন্তু তাতে চিঁড়ে ভেজার ইঙ্গিত মেলেনি এখনও। বরং ইতিমধ্যেই গান্ধী পরিবারের সমর্থন স্পষ্ট হওয়ার পর রাজ্যে রাজ্যে খড়্গের পক্ষে কংগ্রেস নেতানেত্রীদের সমর্থনের ঢল নেমেছে। সেই তালিকায় রয়েছেন ভূপেন্দ্র সিংহ হুডা, পৃথ্বীরাজ চহ্বাণ, মণীশ তিওয়ারির মতো ‘বিদ্রোহী’ জি-২৩ গোষ্ঠীর নেতারাও। দু’বছর আগে যাঁদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কংগ্রেসের অন্দরে সংস্কারের দাবি তুলেছিলেন তারুর।
প্রসঙ্গত, ২০২০-র অগস্টে কংগ্রেসের অন্দরে ‘সুনেতৃত্বের অভাব এবং সাংগঠনিক সমস্যা’ তুলে ধরে অন্তর্বর্তী সভানেত্রী সনিয়াকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন ২৩ জন নবীন এবং প্রবীণ নেতা। দাবি তুলেছিলেন দলে স্থায়ী সভাপতি নির্বাচনের। পাশাপাশি, ‘হাইকমান্ডের’ কর্মপদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন তাঁরা। দলের অন্দরে সেই ‘বিদ্রোহী ২৩’ (গ্রুপ-২৩ বা জি-২৩ নামে যাঁরা পরিচিত) –এর মধ্যেই ছিলেন তারুর। গুলাম নবি আজাদ, কপিল সিব্বল, জিতিন প্রসাদের মতো জি-২৩ নেতাদের কয়েক জন ইতিমধ্যেই দল ছেড়েছেন। বাকিদের অধিকাংশই ‘স্থায়ী সভাপতি নির্বাচনে’ খড়্গের পাশে!
কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনকে ‘আনুগত্য বনাম পরিচিতির লড়াই’ বলে মনে করছেন রাজনীতির কারবারিদের অনেকে। তাঁদের মতে, কর্নাটক এবং কেন্দ্রীয় সরকারে একাধিক দফায় মন্ত্রিত্ব করলেও কখনওই ‘নিজস্ব পরিচিতি’ গড়ে তুলতে পারেননি খড়্গে। ছাপ রাখতে পারেননি কর্মদক্ষতার। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের শেষ ১১ মাস রেলমন্ত্রী থাকা ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনও পদও পাননি। তাই তিন বার কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রিত্বের দাবিদার হয়েও ছিটকে যেতে হয়েছে তাঁকে। এমনকি, নিজের এলাকা গুলবর্গাতেও এই দলিত নেতার ‘জমি’ তেমন শক্ত নয়। ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটে কর্নাটকের ওই আসন থেকে জিতে লোকসভায় কংগ্রেসের নেতা হয়েছিলেন। কিন্তু ২০১৯-এ হেরে গান্ধী পরিবারের আনুকূল্যেই রাজ্যসভায় ঠাঁই হয় তাঁর। রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা হিসাবেও গত সাড়ে তিন বছরে খড়্গে স্বকীয়তার ছাপ রাখতে পারেননি। এমনই তাঁর সমালোচকদের দাবি। তবে বরাবরই অনুগত থেকেছেন হাইকমান্ডের প্রতি। ফলে তিনি সভাপতি হলে দল পরিচালনার ‘চাবি’ গান্ধী পরিবারের হাতেই থাকবে। সেই অঙ্কেই এগিয়ে রয়েছেন খড়্গে।
বস্তুত, ৫৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনে ‘আনুগত্যই’ খড়্গের সবচেয়ে বড় ‘ইউএসপি’ বলে মনে করেন তাঁর সমালোচকেরা। এক বারই সেই ‘ধর্ম’ থেকে বিচ্যুত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৭ সালে লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের ভরাডুবির পরে ইন্দিরা গান্ধীকে ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন দেবরাজ আরসের শিবিরে। কিন্তু ‘হাওয়া’ বুঝে কিছু দিন পরেই ফিরে এসেছিলেন কংগ্রেসের মূলস্রোতে। সেই ইস্তক হাইকমান্ডের অনুগত ৯ বারের বিধায়ক এবং ২ বারের লোকসভা সাংসদ খড়্গে।
কংগ্রেসের অন্দরে অনেকেই স্বীকার করেন, ধারে এবং ভারে খড়্গের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছেন তারুর। রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রাক্তন আন্ডার সেক্রেটারি পদে থাকার সুবাদে আন্তর্জাতিক পরিচিতি রয়েছে। ২০০৬ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব হওয়ার দৌড়েও ছিলেন। শেষ পর্যন্ত মাত্র চারটি ভোটের ব্যবধানে তারুরকে পিছনে ফেলে কোফি আন্নানের উত্তরসূরি হন দক্ষিণ কোরিয়ার বান কি মুন। মাত্র দেড় দশকের রাজনৈতিক জীবনে তারুরের নির্বাচনী সাফল্যও ঈর্ষণীয়। ‘পালাবদলের রাজ্য’ হিসাবে পরিচিত কেরলের তিরুঅনন্তপুরম লোকসভা কেন্দ্রে ২০০৯ সাল থেকে টানা তিন বার জিতেছেন তারুর। তাঁর আগে কোনও ব্যক্তি দূর অস্ত, কোনও রাজনৈতিক দলও টানা তিন বার ওই লোকসভা কেন্দ্রের দখল পায়নি। মনমোহন সিংহের সরকারের বিদেশ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন তারুর।
গান্ধী পরিবারের প্রতি নিখাদ আনুগত্য সত্ত্বেও খড়্গেকে কখনও ব্যক্তি আক্রমণের শিকার হতে হননি। বস্তুত, কংগ্রেস নেতাদের একাংশ মনে করেন আদ্যন্ত ‘লো প্রোফাইল’ এই নেতাকে আক্রমণের যোগ্যই মনে করেনি পদ্মশিবির। অন্য দিকে, ২০১২ সালে আইপিএল-বিতর্ক প্রকাশ্যে আসার পরে তারুরের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছিলেন গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্বয়ং। ২০১২-র গুজরাত বিধানসভা ভোটের সময় অধুনাপ্রয়াত সুনন্দা পুষ্করের সঙ্গে তারুরের সম্পর্ক নিয়ে নিয়ম করে খোঁচা দিতেন মোদী। জনসভায় আমজনতার উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়তেন— ‘‘আপনারা কখনও আড়াই কোটির গার্লফ্রেন্ড দেখেছেন?’’
মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে কিন্তু তারুর পাল্টা ব্যক্তি আক্রমণের পথে হাঁটেননি। বরং ২০১৯-এর ভোটের আগে তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি রাহুলের রাজনৈতিক অবস্থানের বিরোধিতা করে জানিয়েছিলেন, ব্যক্তি মোদীকে নিশানা করলে রাজনৈতিক ভাবে ক্ষতি হবে কংগ্রেসের। ইতিহাস বলছে, সে দিন তারুরের মূল্যয়ন ঠিক ছিল। আর বর্তমান বলছে, মা সনিয়ার মতোই ছেলে রাহুলের সমর্থন পাওয়ার ক্ষেত্রেও আনুগত্যের মাপকাঠিতে জিতে গিয়েছেন নির্বিবাদী খড়্গে।