পার্ক করে রাখা ট্রাক্টরই এখন আন্দোলনরত কৃষকদের অস্থায়ী আস্তানা। নয়াদিল্লির সিঙ্ঘু সীমানায়। পিটিআই
মুকেশ অম্বানী বা গৌতম আদানি নয়। চাষিদের আয় বাড়াতেই যে কৃষি সংস্কার, তা প্রমাণ করতে তিন কৃষি আইনের পক্ষে মোদী সরকার দশ দফা যুক্তি তৈরি করেছে। দিল্লি ঘেরাও করে কৃষক সংগঠনগুলির আন্দোলনের চাপে বৃহস্পতিবার ফের মোদী সরকারের মন্ত্রীরা কৃষক নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন। সেখানেই সরকারের তরফে এই যুক্তি তুলে ধরা হবে।
মোদী সরকারের অন্দরমহলের খবর, কর্পোরেট সংস্থার স্বার্থে কৃষি আইন আনা হয়েছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, সেটাই সরকারের প্রধান দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে বারাণসী থেকে বলেছিলেন, কৃষি আইনের পিছনে সরকারের উদ্দেশ্য গঙ্গাজলের মতোই পবিত্র। কিন্তু বুধবার কৃষক সংগঠনগুলি ঘোষণা করেছে, ৫ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী মোদী, মুকেশ অম্বানী, গৌতম আদানিদের কুশপুতুল পোড়ানো হবে। কেন্দ্রের এক মন্ত্রীর কথায়, “কুশপুতুল দাহ নতুন নয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দুই শিল্পপতির কুশপুতুল পোড়ানো হলে তা অন্য অর্থ বহন করে। সেটাই চিন্তার।”
মঙ্গলবার কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিংহ তোমরের সঙ্গে বৈঠকে কৃষক সংগঠনের নেতারা প্রশ্ন তুলেছিলেন, চাষিরা তো কৃষি আইনের দাবি জানাননি। কাদের কথায় আইন এল? বুধবার কৃষক নেতারা তাঁদের আপত্তি লিখিত ভাবে সরকারের কাছে জমা দিয়েছেন। বৃহস্পতিবারের বৈঠকে সরকারের তরফে কৃষি মন্ত্রক, নীতি আয়োগের তৈরি পাল্টা যুক্তি তুলে ধরা হবে।
কী সেই যুক্তি? নীতি আয়োগের সদস্য তথা কৃষি বিশেষজ্ঞ রমেশ চাঁদের বক্তব্য, ১৯৯১-এ আর্থিক সংস্কার হলেও কৃষি ক্ষেত্র তার আওতায় পড়েনি। সেই সংস্কারের পরে দেখা যায়, কৃষি বাদে অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নতির সুবাদে আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়তে শুরু করেছে। তার ফল দেখা গিয়েছে কৃষক ও অন্যান্য ক্ষেত্রের কর্মীদের আয়ের ফারাকে। রমেশের হিসেবে, ১৯৯৩-৯৪-এ এক জন কৃষক ও এক জন অ-কৃষি শ্রমিকের বার্ষিক গড় আয়ের মধ্যে ফারাক ছিল ২৫,৩৯৮ টাকা। ১৯৯৯-২০০০-এ তা হয় ৫৪,৩৭৭ টাকা। ২০০৯-১০-এ সেই ফারাক পৌঁছে গিয়েছে ১.৪২ লক্ষ টাকায়। কৃষি মন্ত্রকের যুক্তি, এই ফারাক মিটিয়ে চাষিদের আয় বাড়াতেই তিন আইনে কর্পোরেট সংস্থাকে চুক্তির ভিত্তিতে চাষ করিয়ে নিয়ে সরাসরি চাষিদের থেকে ফসল কিনে নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই সংস্থাগুলিকে যত ইচ্ছে চাল, ডাল, গম, আলু, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল মজুত করার ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। আবার চুক্তি চাষে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার জন্যও আইন হয়েছে। কিন্তু বিরোধীরা আইনগুলি কর্পোরেটদের স্বার্থে করা হয়েছে বলে মিথ্যে প্রচার করছে।
এর আগে রাহুল গাঁধী মোদী সরকারের গায়ে ‘সুট-বুট কি সরকার’-এর তকমা লাগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এ বার রাহুল ফের ‘ঝুট কি, লুঠ কি, সুট-বুট কি সরকার’ তকমা দিয়ে অভিযোগ তুলেছেন, প্রধানমন্ত্রী চাষিদের আয় দ্বিগুণ করার কথা বলে তাঁর ‘মিত্রোঁ’-দের আয় চার গুণ করেছেন।
কৃষি মন্ত্রক, নীতি আয়োগের কর্তাদের যুক্তি, সরকারি নিয়ন্ত্রণ কমলে চাষিদেরই লাভ। তার প্রমাণ হল, খাদ্যশস্যের তুলনায় দুধ, মৎস্যচাষ, ফুল-ফলের চাষে বৃদ্ধি অনেক বেশি। যেখানে সরকার কার্যত নাক গলায় না। রমেশের মতে, দেশে ছোট চাষিদের সংখ্যা কম। তাঁদের ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতাও কম। চুক্তি চাষে সঠিক দামে ফসল বিক্রির নিশ্চয়তা থাকলে তাঁরা বেশি দামের ফসল চাষ করবেন। দেশে কিছু ফসল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি উৎপাদন হয়। আবার বিপুল পরিমাণ ভোজ্যতেল, ডাল আমদানি করতে হয়। বিপণন ও মজুতের পরিকাঠামোর অভাব এর কারণ। রফতানিও বাড়ানো দরকার। আগামী কয়েক বছরে কৃষি ও খাদ্যপণ্য উৎপাদন যে পরিমাণে বাড়বে, তার ২০-২৫ শতাংশ রফতানি করতে হবে। কারণ জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার কমছে। কৃষি উৎপাদনের বৃদ্ধির হার বাড়ছে। এ জন্যই বেসরকারি লগ্নি দরকার।