(বাঁ দিকে) অমিত শাহ এবং অরবিন্দ কেজরীওয়াল। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
আড়াই মাস আগে নরেন্দ্র মোদী সরকার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে পাশ কাটিয়ে দিল্লির প্রশাসনিক ক্ষমতার রাশ হাতে রাখার জন্য যে অর্ডিন্যান্স (অধ্যাদেশ) জারি করেছিল, এ বার সংসদের বাদল অধিবেশনে তা পাশ করিয়ে পুরোদস্তুর আইনের চেহারা দেওয়ার চেষ্টা শুরু হল। মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ‘ডেপুটি’ নিত্যানন্দ রাই লোকসভায় বিলটি পেশ করার পরেই দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীওয়ালের দল ‘আম আদমি পার্টি’ (আপ)-র সুশীলকুমার রিঙ্কু-সহ বিরোধী সাংসদেরা প্রতিবাদ শুরু করেন। ‘জাতীয় রাজধানী অঞ্চল দিল্লি (সংশোধনী) বিল ২০২৩’-কে ‘গণতন্ত্রের পরিবর্তে বাবুতন্ত্রের সূচনা’ বলে বর্ণনা করেন তাঁরা।
মোদী সরকারের ওই বিতর্কিত অর্ডিন্যান্স সংক্রান্ত মামলা সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চে বিচারাধীন। শীর্ষ আদালত গত মাসে জানিয়েছে, অর্ডিন্যান্সের সাংবিধানিক বৈধতা খতিয়ে দেখা হবে। সেই সঙ্গে যাচাই করা হবে, এ বিষয়ে সংসদের অধিকারের সীমাও। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই লোকসভায় বিল পেশ করায় মণিপুরকাণ্ডের জেরে উত্তপ্ত বাদল অধিবেশনে নতুন করে অশান্তি ছড়াতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ।
বিরোধীদের অভিযোগ উড়িয়ে শাহ মঙ্গলবার বলেন, ‘‘দিল্লি জাতীয় রাজধানী অঞ্চল’। সেখানকার প্রশাসনিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার সংসদের রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিরোধীদের প্রতিবাদ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’’ শাহের মন্তব্যের পরেই সভায় বিক্ষোভ শুরু করেন ‘ইন্ডিয়া’-র সাংসদেরা। আপের রিঙ্কু এবং কংগ্রেস সাংসদ টিএন প্রথাপন কাগজ ছোড়ায় স্পিকার ওম বিড়লা তাঁদের সতর্ক করেন। বলেন, ‘‘এমন আচরণ ঠিক নয়। দেশবাসী আপনাদের দেখছে।’’
তবে গত ১৯ মে মোদী সরকারের অর্ডিন্যান্সের থেকে নয়া বিলের খসড়ায় কিছুটা বদল করা হয়েছে। অর্ডিন্যান্সের ৩এ ধারাটি বিলের খসড়ায় বাদ দেওয়া হয়েছে। রাখা হয়েছে শুধুমাত্র ভারতীয় সংবিধানের ২৩৯এএ অনুচ্ছেদের প্রসঙ্গ। ওই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনও আদালতের কোনও রায়, নির্দেশ বা ডিক্রিতে যা কিছুই থাকুক না কেন, ওই অনুচ্ছেদে অনুযায়ী আইন প্রণয়নের ক্ষমতা আইনসভার। প্রসঙ্গত, গত ২০ জুলাই প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ নির্দেশে বলেছিল, ‘‘জন পরিষেবা সংক্রান্ত ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে শাসনের সাংবিধানিক নীতিতে হস্তক্ষেপ করা যায় কি না, সাংবিধানিক বেঞ্চ তা বিবেচনা করবে।’’ এমনকি, সংসদ সংবিধানের ২৩৯এএ অনুচ্ছেদে বদল ঘটিয়ে জাতীয় রাজধানী অঞ্চল দিল্লির শাসন ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে কি না, তা-ও ‘সাংবিধানিক বেঞ্চের বিচার্য’ বলে জানানো হয়েছে তিন বিচারপতির বেঞ্চের নির্দেশে।
১০ পাতার ওই নির্দেশে বলা হয়, অর্ডিন্যান্সের ৩এ ধারা সরাসরি দিল্লি সরকারের হাতে থাকা ৪১ নম্বর ধারা (পরিষেবা সংক্রান্ত ক্ষমতা)-য় হস্তক্ষেপ করছে। ফলে তার সাংবিধানিক বৈধতা বিবেচনার অবকাশ রয়েছে। এর পরে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির বেঞ্চ মামলাটি পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চে পাঠিয়েছিল। সেখানে এখন মামলাটি বিচারাধীন। এই পরিস্থিতিতে শীর্ষ আদালতের হস্তক্ষেপ এড়াতেই খসড়া বিলে মোদী সরকারের এই অবস্থান বদল বলে মনে করা হচ্ছে।
নয়া বিলের খসড়ায় ‘জাতীয় রাজধানী সিভিল সার্ভিস অথরিটি’র বার্ষিক প্রতিবেদন সংসদ এবং দিল্লি বিধানসভায় পেশ করা ‘বাধ্যতামূলক’ করা হয়েছে বলেও সরকারি সূত্রের খবর। পাশাপাশি জানানো হয়েছে, আমলাদের উদ্দেশে দিল্লির মন্ত্রীরা যে নির্দেশিকা পাঠাবেন লেফটেন্যান্ট গভর্নর (উপরাজ্যপাল) এবং মুখ্যমন্ত্রীর আগে তা কেন্দ্রকে পাঠাতে হবে। এ ছাড়া অর্ডিন্যান্সে পরিষেবা সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের রাজ্য বিধানসভার ভূমিকা পুরোপুরি ছেঁটে ফেলা হলেও বিলে তা হয়নি।
খসড়ায় জানানো হয়েছে, রাজ্য সরকারের ক্ষমতা শুধুমাত্র রাজ্য বিধানসভা দ্বারা তৈরি এবং পরিচালিত সংস্থাগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। কেন্দ্রের আনা বিলের বিরোধিতার জন্য ইতিমধ্যেই কংগ্রেস-সহ বিভিন্ন বিরোধী দল তাদের সাংসদদের উদ্দেশে হুইপ জারি করেছে। যদিও লোকসভায় মোদী সরকারের বিপুল গরিষ্ঠতা রয়েছে। রাজ্যসভাতেও অন্ধ্রের শাসকদল ওয়াইএসআর কংগ্রেসের সমর্থন মেলায় বিল পাশ কার্যত নিশ্চিত। ঘটনাচক্রে, ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েকের দল বিজেডি মঙ্গলবার কেন্দ্রের দিল্লি-বিল সমর্থনের কথা জানিয়েছে।