কোভিডের প্রকোপ আগের তুলনায় বেশ খানিকটা কমলেও, যাতায়াত, স্কুল খোলা, নৈশবিধির মতো নানা ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম কড়াকড়ি বহাল রয়েছে রাজ্যগুলিতে। কোথাও স্কুল আগে খুলেছে, কোথাও পরে। সব ক্লাসও এক সঙ্গে স্কুলে ফেরেনি।
ফাইল চিত্র।
ওমিক্রন আতঙ্কের হাত ধরে আসা কোভিডের তৃতীয় ঢেউ যে মাথা নোয়াতে শুরু করেছে, বেশ কিছু দিন ধরেই তার ইঙ্গিত মিলছিল সংক্রমণের পরিসংখ্যানে। পশ্চিমবঙ্গ-সহ সারা দেশে কমছে সংক্রমিতের সংখ্যা। নিম্নমুখী সংক্রমণের হারও। এই অবস্থায় করোনা নিয়ন্ত্রণে জারি থাকা ‘বাড়তি’ কড়াকড়ি পুনর্বিবেচনার জন্য সমস্ত রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে চিঠি দিল স্বাস্থ্য মন্ত্রক।
ওই চিঠিতে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যসচিব রাজেশ ভূষণ লিখেছেন, সারা দেশেই ২১ জানুয়ারি থেকে সংক্রমণের রেখচিত্র টানা পড়তির দিকে। এই অবস্থায় নিজেদের অঞ্চলে সংক্রমণ-পরিস্থিতি বিচার করে সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল যদি বাড়তি কড়াকড়ি শিথিল করে, বিধি পরিবর্তন করে, এমনকি তা তুলেও নেয়, তা হলে সেটি ফলপ্রসূ হবে। তবে ভূষণ স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে দৈনিক সংক্রমিতের সংখ্যা, অ্যাক্টিভ রোগীর সংখ্যা এবং সংক্রমণের হারের দিকে কড়া নজর রেখে। দেখতে হবে, ফের তা মাথাচাড়া দিচ্ছে কি না।
কোভিডের প্রকোপ আগের তুলনায় বেশ খানিকটা কমলেও, যাতায়াত, স্কুল খোলা, নৈশবিধির মতো নানা ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম কড়াকড়ি বহাল রয়েছে রাজ্যগুলিতে। কোথাও স্কুল আগে খুলেছে, কোথাও পরে। সব ক্লাসও এক সঙ্গে স্কুলে ফেরেনি। কোনও রাজ্যে দেশের মধ্যে সব রুটে সপ্তাহে সাত দিন উড়ান আসা-যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা নেই, কোথাও এখনও তা আছে। একই রকম ফারাক নৈশবিধির ক্ষেত্রে। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, পরিস্থিতি অনুকূল হলে, এ ধরনের বাড়তি কড়াকড়ি শিথিল করা কিংবা ফিরিয়ে নেওয়ার কথাই বলেছে কেন্দ্র।
চিঠির বয়ান অনুযায়ী, ২১ জানুয়ারি দেশে সংক্রমিতের সংখ্যা ছিল ৩,৪৭,২৫৪। সেখানে গত সপ্তাহে দৈনিক সংক্রমণ ৫০,৪৭৬। চিঠিতে যে তারিখ রয়েছে (১৫ ফেব্রুয়ারি), তার আগের ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে সংক্রমিত হয়েছেন ২৭,৪০৯ জন। সংক্রমণের হার ৩.৬৩ শতাংশে নেমে এসেছে ১৫ ফেব্রুয়ারি। জানুয়ারির শেষেও যা ঘোরাফেরা করছিল ১৫ শতাংশের আশপাশে। শুধু তা-ই নয়, কোভিডে বিধ্বস্ত অর্থনীতির চাকায় গতি ফেরাতে কড়াকড়ি শিথিলের
পথে হাঁটছে বাকি বিশ্ব। মনে করা হচ্ছে, সেই একই লক্ষ্যে গত দু’বছরে এই প্রথম এত স্পষ্ট ভাবে কড়াকড়ি শিথিলের বার্তা দিল মোদী সরকার। যদিও অনেকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, গত ২৪ ঘণ্টায় সংক্রমিতের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে।
মাস্ক পরা, দূরত্ববিধি মেনে চলার মতো বিষয়গুলি সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে যে দীর্ঘদিন সাবধান ও সচেতন থাকতে হবে, তা বারবার বলেছে কেন্দ্র। কিন্তু গত কয়েক মাসে সীমানা ও বিমানবন্দরের মতো কিছু ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজ্য যে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ জারি করেছিল, সেই প্রসঙ্গ উঠে এসেছে চিঠিতে। বলা হয়েছে, জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সঙ্কটের মোকাবিলা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই বিভিন্ন রাজ্যের সীমানায় বাড়তি বিধিনিষেধের জন্য মানুষের যাতায়াত এবং অর্থনীতির গতি যাতে থমকে না যায়, তা নিশ্চিত করাও জরুরি। তবে বিধি শিথিল করলেও, জোর বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে পাঁচটি বিষয়ে: পরীক্ষা, অনুসন্ধান, চিকিৎসা, প্রতিষেধক ও নিয়ম মেনে চলা।
অতিমারির বিপদ যে এখনও কাটেনি, সে কথা নিয়মিত বলে চলেছে কেন্দ্র, রাজ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)— সকলেই। ভেল্লোরের ক্রিশ্চান মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিশেষজ্ঞ টি জেকব জনের মতে, অতিমারি ‘এন্ডেমিক’ স্তরে (শেষের ধাপ) এখনও পৌঁছয়নি। আরও অনেক মাস এর জের থাকবে। তবে ওমিক্রনের থেকে সংক্রামক আর ডেল্টার থেকেও মারাত্মক কোনও স্ট্রেন আসার সম্ভাবনা কম বলে তাঁর আশ্বাস। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, এই অবস্থায় ধীরে ধীরে স্বাভাবিকতার পথে পা বাড়াতে চাইছে ভারত-সহ সমস্ত দেশই। বিরোধী শিবির, অর্থনীতিবিদদের অনেকের অভিযোগ ছিল, দেশজোড়া লকডাউন যে ভাবে অর্থনীতিকে ধাক্কা দিয়েছে, তার জেরে প্রবল ক্ষতি হয়েছে ছোট-মাঝারি ব্যবসার। কাজ খুইয়েছেন বহু মানুষ। ক্ষত এতই গভীর যে, কষ্টেসৃষ্টে কোভিডের আগের আয়তনে পৌঁছেছে অর্থনীতির আয়তন। পরিস্থিতি বুঝে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুখেও শোনা গিয়েছে পরিবর্তিত স্লোগান, ‘জীবনের সঙ্গে জীবিকাও জরুরি’।
অনেকে মনে করছেন, কোভিড-পরিস্থিতি কিছুটা ভাল দেখানোয় এ বার অর্থনীতিকে দ্রুত চাঙ্গা করার দিকে মন দিতে চাইছে কেন্দ্র। বিরোধীদের বক্তব্য, ২০২৪ সালের আগে বৃদ্ধির চমকপ্রদ হার তুলে ধরতে চাইছেন মোদী। যাতায়াত-সহ বিভিন্ন বিষয়ে কড়াকড়ি যত থাকবে, অর্থনীতির হাল তত দেরিতে শোধরানোর সম্ভাবনা। অনেকের মতে, সেই কারণেই বাড়তি কড়াকড়ি কমানোর কথা বলছে কেন্দ্র। চিঠিতে সচিবও লিখেছেন, ‘আমি নিশ্চিত, রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলি জীবন ও জীবিকার উপরে আঁচ যথাসম্ভব কমিয়েই কোভিড-সঙ্কটের মোকাবিলা করতে পারবে।’