কলকাতা বিমানবন্দরে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস।
‘চিনের মডেল’কে সামনে রেখে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নে উদ্যোগী নিয়েছিলেন। সিপিএমের অন্দরমহলে এ নিয়ে জোর বিতর্ক হয়েছিল ২০১১-র নভেম্বরে। পশ্চিমবঙ্গে সাড়ে চৌত্রিশ বছরের বাম সরকারের পতনের পরে। তৈরি হয়েছিল মতাদর্শগত দলিল।
খাতায়-কলমে এই দলিলের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল, চিনে ‘সমাজতন্ত্র’ নামে যে ব্যবস্থা চলছে, তা কি এ দেশেও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সঠিক উপায়? তবে বিতর্কের আসল বিষয় ছিল, চিনে যে ভাবে বড় পুঁজিপতিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শিল্পায়ন হচ্ছে, তা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঠিক পথ হতে পারে না। এই বিতর্কের এক মেরুতে ছিলেন সিপিএমের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট। আর উল্টো মেরুতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, নিরুপম সেন ও তাঁদের শিল্পনীতি।
সিপিএমের কট্টরপন্থীদের যুক্তি ছিল, পুঁজিপতিদের সঙ্গে জোট বাঁধতে গিয়ে চিনের কমিউনিস্ট পার্টি পুঁজিপতিদের দলে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও টাটা-জিন্দল-সালিমদের সঙ্গে বুদ্ধদেব-নিরুপমের দহরম-মহরম দেখে একই ভুল বার্তা গিয়েছে। চিনে যে-ভাবে গায়ের জোরে জমি অধিগ্রহণ করে শিল্পায়ন সম্ভব নয়, এ দেশে তা হয় না। সে চেষ্টা হলেই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের মতো প্রতিরোধ হবে। এই কারণেই জ্যোতি বসু শ্রমিক-কৃষক শ্রেণির স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে শিল্পায়নের কথা বলেছিলেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ‘আমরা ২৩৫, ওরা ৩০’ মন্তব্য নিয়েও সমালোচনা হয়েছিল।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বুঝতে পেরেছিলেন, মতাদর্শগত দলিল তৈরি করে তাঁকেই ভুল প্রমাণিত করার চেষ্টা হচ্ছে। সেই সময় থেকেই নিজের আপত্তি জানানোর ক্ষেত্রে এক অভিনব পন্থা নিয়েছিলেন। তা হল, দিল্লিতে সিপিএমের পলিটব্যুরো বা কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক এড়িয়ে যাওয়া। অথবা এলেও বৈঠকের মাঝ পথে বেরিয়ে যাওয়া।
এমনিতেও দিল্লিতে সরকারি সম্মেলন বা দলের বৈঠকে যোগ দিতে এলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের তিনটিই গন্তব্য ছিল। এক, গোল মার্কেটে সিপিএমের সদর দফতর এ কে গোপালন ভবন। দুই, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের বাসভবন। তিন, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি। এর বাইরে তিনি বাকি সময় হেলি রোডের বঙ্গভবনে কাটাতেন। কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক থেকে মাঝপথে বেরিয়ে গেলেও বঙ্গভবনে একান্তে সময় কাটিয়ে দিতেন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের অনুরাগী বুদ্ধদেব।
যে কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরই দিল্লিতে আসাযাওয়ার সুবাদে বহু কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, আমলাদের সঙ্গে সখ্য তৈরি হয়। বুদ্ধদেবের একমাত্র ঘনিষ্ঠতা ছিল প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তবে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গেও তাঁর সখ্য তৈরি হয়েছিল। মনমোহনের মিডিয়া উপদেষ্টা সঞ্জয় বারু লিখেছিলেন, মনমোহন সিংহ মুখ্যমন্ত্রীদের চিঠি লিখলেও তাঁদের সঙ্গে একান্তে প্রাতরাশ বা নৈশভোজে উৎসাহী ছিলেন না। তবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে তিনি স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। তাই একাধিক বার একান্তে নৈশভোজও করেছেন।
২০০৮-এ মনমোহন সরকারের থেকে বামেদের সমর্থন প্রত্যাহারের পর থেকেই সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতভেদ তৈরি হয়। ২০০৯-এ লোকসভা ভোটে বামেদের খারাপ ফলের পর বিজয়ওয়াড়ায় সিপিএমের বর্ধিত কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক বসেছিল। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের ফলের পর্যালোচনায় বাংলার বাম সরকার, সংগঠনের কড়া সমালোচনা ছিল। বুদ্ধদেব প্রথম দিনের সম্মেলনেই যাননি। ২০১১-য় বাম দুর্গ পতনের পরে জুন মাসে হায়দরাবাদে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক বসেছিল। বিমানের টিকিট কেটেও হায়দরাবাদে যাননি বুদ্ধদেব। পরের বছর কোঝিকোড়ে সিপিএমের পার্টি কংগ্রেসেও গরহাজির ছিলেন। অনুপস্থিতি ও নীরবতার মধ্যে প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে নিয়েছিলেন বুদ্ধদেব।
মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের সংঘাত হয়েছিল মাওবাদী সমস্যা নিয়ে। সে সময় কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমের ধারণা ছিল, কমিউনিস্টরা মাওবাদীদের ‘কমরেড ইন আর্মস’ মনে করে। নেতাইয়ে গণহত্যার পরে চিদম্বরম বুদ্ধদেবকে ‘হার্মাদ শিবির’ বন্ধ করতে বলে চিঠি লিখেছিলেন। পত্রপাঠ তাঁর সঙ্গে দিল্লিতে এসে দেখা করতে বলেছিলেন। বুদ্ধদেব সেই চিঠির ভাষা নিয়ে তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন। পরে দিল্লিতে এলে চিদম্বরম তাঁকে বলেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁকেই দায় নিতে হবে। বুদ্ধদেব পাল্টা বলেছিলেন, ইউপিএ সরকার আগে শরিক দল তৃণমূল কংগ্রেসকে মাওবাদীদের সাহায্য করা থেকে বিরত করুক।
দিল্লিতে বিজেপি শিবিরের সঙ্গে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের যোগাযোগ ছিল খুবই সীমিত। তবে তার মধ্যেও লালকৃষ্ণ আডবাণীর সঙ্গে তাঁর কিছুটা নৈকট্য তৈরি হয়েছিল। আডবাণী যখন বাজপেয়ী সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সে সময় পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকায় আইএসআই-এর কার্যকলাপ রুখতে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আড়বাণীর সঙ্গে দেখা করে কেন্দ্রের সাহায্য চেয়েছিলেন। আডবাণী সবরকম সাহায্যের আশ্বাস দেন। রাজনৈতিক মতভেদ থাকলেও বুদ্ধদেবের প্রশাসনিক অবস্থান আডবাণীকে মুগ্ধ করেছিল। ইউপিএ সরকার ক্ষমতায় আসার পরেও সেই যোগাযোগ ছিল।
শিবরাজ পাটিল যখন ইউপিএ সরকারের কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তখন দার্জিলিংয়ের গোর্খা পার্বত্য পরিষদকে স্বশাসিত সংস্থার মর্যাদা দিতে সংসদে বিল এনেছিলেন। বাম সমর্থিত ইউপিএ সরকারের সেই বিল আটকানোর জন্য সাহায্য চাইতে বুদ্ধদেব সে সময় লোকসভার বিরোধী দলনেতা আডবাণীর বাড়ি গিয়ে তাঁর সাহায্য চেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের সমস্যা নিয়ে সংসদে এক আলোচনায় আডবাণী বলেছিলেন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এই সমস্যার গুরুত্ব বোঝেন। তাই এ নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে সহযোগিতাও করেন।
তবে ইউপিএ সরকার হোক বা গোপালন ভবন, মতান্তর থাকলেও দিল্লির নেতারা জানতেন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের প্রতি দায়বদ্ধ। ২০০৮-এ শালবনিতে ইস্পাত কারখানার শিলান্যাস করে ফেরার সময় মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় লক্ষ্য করে মাওবাদীরা ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ করে। বুদ্ধদেব অল্পের জন্য রক্ষা পান। সেই কনভয়ে সে সময়ে ইস্পাত মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী জিতিন প্রসাদও ছিলেন। দিল্লি ফিরে জিতিন বলেছিলেন, প্রাণঘাতী হামলা থেকে বেঁচে ফিরেও বুদ্ধদেবের প্রতিজ্ঞা ছিল, কারখানায় কেউ বাধা দিতে পারবে না।