হায়দর আলি (বাঁ দিকে) এবং জিয়ারুল। নিজস্ব চিত্র।
আমি হায়দর।
আর আমি জিয়ারুল।
আমরা স্কুল ছাড়লেও স্কুল যে আমাদের ছাড়ে না।
যেমন ছাড়ে না এই পতাকার টান।
অবশ্য এই স্কুলটা হয়তো আমাদের ছেড়ে চলে যাবে আসছে বছর। বড়জোর বছর দুয়েক।
২০১৭ সালে বন্যার গলাজলে দাঁড়িয়ে পতাকা তোলার ছবিটা আমাদের দুই খুড়তুতো ভাইকে বেশ বিখ্যাত করেছিল। আর খ্যাতির দৌলতেই ওই প্রথম ও শেষ বার গুয়াহাটি গিয়েছিলাম আমরা। সেই ঘটনার এ বার পাঁচ বছর। তখন আমাদের নিম্ন বুনিয়াদি স্কুলটা থেকে ব্রহ্মপুত্র ছিল কয়েক কিলোমিটার দূরে। এখন দূরত্ব মাত্র এক কিলোমিটারের। আগের স্কুলটা এখন একই চত্বরে নস্করা মধ্য ইংরাজি স্কুলের সঙ্গে এক হয়ে গিয়েছে। বন্যা জুন-জুলাইয়েই শেষ। জল তেমন না জমলেও, নদীর ভাঙন যে ভাবে চলছে—তাতে আমাদের এই আদরের স্কুলবাড়িটাও আর বোধহয় বেশি দিন নেই!
বন্যার থেকেও আমাদের আরও ভয়ানক সমস্যা—বিঘার পর বিঘা জমি নদীর বুকে তলিয়ে যাচ্ছে। আমাদের এখানকার সবচেয়ে বড় স্কুল স্বাধীনতার আগে তৈরি হামিদাবাদ উচ্চমাধ্যমিক স্কুল। সেই স্কুলটাও বাঁচানো যায়নি। এক জায়গায় স্কুলের জমি ভাঙে তো অন্য জমি খুঁজতে হয়।
আমাদের বন্ধুদের অনেকেই বাড়ি হারিয়ে স্কুলে বা রাস্তার উপরে ত্রিপল টানিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। কেউ আবার আশ্রয় নিয়েছে চরে। কিন্তু সারাক্ষণ ভয় তাড়িয়ে বেড়ায়। এই বুঝি সরকারি বুলডোজ়ার তেড়ে এল।
সালে বন্যার জলে দাঁড়িয়ে জাতীয় পতাকাকে অভিবাদন হায়দরদের। ফাইল চিত্র
আমি হায়দর, বাড়িতে বাবা নেই। মা আছেন। বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করেন। দাদা ক্লাস নাইনে পড়ে। আমি ক্লাস ফাইভে।
আর আমি জিয়ারুল। বাবা খেতি করেন। বড় দাদা গুয়াহাটিতে হাজিরা করে রোজগার করে। মেজ দাদা মসজিদে নমাজ পড়ায়। আমি এখন ক্লাস এইট।
করোনায় দুই বছর যে ক্লাস বন্ধ ছিল, আমাদের তো অনলাইন ক্লাসও হয়নি। হবে কী করে! স্মার্টফোন তো কোনও রকমে কেনা হয়েছে বাড়িতে। কিন্তু বিদ্যুৎ থাকে না। ভোল্টেজ এমনই কম যে মোবাইলও চার্জ হয় না। নেটওয়ার্কের অবস্থাও তেমন।
আমাদের জেলা দক্ষিণ শালমারা হলেও কাজকর্ম ধুবুড়িতেই। স্কুলে যাওয়ার একটুখানি রাস্তা নতুন হয়েছে বটে। কিন্তু ফকিরগঞ্জ থেকে লক্ষ্মীপুর যাওয়ার রাস্তাটা যে কত খারাপ তা বলে বোঝাতে পারব না।
আমাদের গ্রামে কারও ছোটখাটো শরীর খারাপ হলে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যায় আল্লার ভরসায়। আর বেশি শরীর খারাপ হলে নিতে হয় ধুবুড়ি বা গোয়ালপাড়া। ধুবুড়ি যেতে ২ ঘণ্টা ধরে ব্রহ্মপুত্র পার করতে হয়। ফেরি চলে দিনে দুই বার। সকাল ৮টা আর বিকেল ৩টেয়। আর গোয়ালপাড়া যাওয়ার রাস্তার যা অবস্থা, শরীর বেশি খারাপ হলে পথেই প্রাণ বেরিয়ে যাবে।
আমি হায়দর, আর্মিতে যেতে চাই। দেশের জন্য লড়তে চাই। কারণ, দেশকে ভালবেসে ওড়ানো পতাকা যে কত ভালবাসা দিতে পারে তা তো দেখেছি। কিছু দিনের জন্য প্রাইভেট স্কুলে পড়তে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু এক বছর পরে আবার ফিরে এসেছি পুরনো স্কুলেই। বলছিলাম না, আমরা স্কুল ছাড়লেও নস্করা স্কুল আমাদের ছাড়ে না।
আর আমি জিয়ারুল, হতে চাই ডাক্তার। পতাকা তোলায়, যত সম্মান পেয়েছি তত যেন নিজের প্রতি, পড়াশোনার প্রতি ভালবাসা বেড়েছে। ক্লাসে এখন প্রথম তিনের মধ্যে থাকি। গ্রামের অসুস্থ মানুষদের যে দুর্দশা রোজ দেখছি, তাতে ইচ্ছে হয় যদি নিজেই ওষুধ দিয়ে, ইঞ্জেকশন দিয়ে মানুষকে ভাল করে দিতে পারতাম!
গ্রামে এমবিবিএস ডাক্তার না থাকা নিয়ে মিজানুর স্যার প্রধানমন্ত্রীকেও চিঠি পাঠিয়েছিলেন। লাভ হয়নি। মিজানুর স্যারই আমাদের পতাকা তোলার ছবি তুলেছিলেন। তিনি এখন আর পড়ান না আমাদের। প্রোমোশন পেয়েছেন।
এ বছর স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব। আমাদেরও স্কুলে ব্যস্ততা। চার দিকে তেরঙার রঙ। আমরাও পতাকা কিনব। বাড়িতে তিন দিন ধরে পতাকা ওড়াতে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
এখানে অনেক অভাব। অনেক হাওয়াও। পতাকাটা ভালই উড়বে। ওই পতাকা দিয়েই তো আমাদের পরিচয়, আমাদের স্কুলের পরিচয়।
অনুলিখন রাজীবাক্ষ রক্ষিত