রেডিওয় ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠান থেকে ঝাড়খণ্ড সফর— রবিবার দিনভর প্রসঙ্গটার ধারকাছ দিয়েই গেলেন না নরেন্দ্র মোদী। বসুন্ধরা রাজে ও সুষমা স্বরাজকে নিয়ে বিতর্ককে কার্যত উপেক্ষা করে যেন বুঝিয়ে দিতে চাইলেন, তাঁর দল ও সরকারে সব কিছুই স্বাভাবিক আছে। ললিত মোদী কাণ্ড নিয়ে সংসদের আসন্ন অধিবেশনে বিরোধীদের হট্টগোলে সংস্কারমুখী বিলগুলি পাশ করানোই দুষ্কর হয়ে পড়বে, এমন একটা আশঙ্কার কথা ক’দিন ধরে তুলছিলেন কেউ কেউ। বিজেপির অন্দরের খবর হল, এক দিকে মোদী যখন প্রকাশ্যে এই বিতর্ককে উপেক্ষার কৌশল নিলেন, তখন বাদল অধিবেশন স্তব্ধ হওয়া রুখতে তলে তলে বিরোধী জোটকে ভাঙার (বলা ভাল, কংগ্রেস থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করার) চেষ্টাও শুরু করে দিয়েছে সরকার পক্ষ।
ললিত-কাণ্ডে প্রধানমন্ত্রী কেন ‘মৌন’, তা নিয়ে রোজ প্রশ্ন তুলে চলেছে কংগ্রেস। ইউপিএ জমানায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেই মনমোহন সিংহকে ‘মৌনমোহন’ বলে কটাক্ষ করত বিজেপি। সেই কটাক্ষই এখন ফেরত পাচ্ছে তারা। বস্তুত, ‘মন কি বাত’-এর দীর্ঘ বক্তৃতায় এবং পরে ঝাড়খণ্ডের অনুষ্ঠানে সুষমা-বসুন্ধরার প্রসঙ্গ মোদী পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়ায় আজও তোপ উড়ে এসেছে কংগ্রেস শিবির থেকে। মোদীর এ দিনের মোদ্দা বক্তব্য হল, ‘সরকার তার কাজ করে চলেছে।’ যার উত্তরে কংগ্রেস নেতা গুলাম নবি আজাদ বলেন, ‘‘যখন গোটা দেশ ললিত-কাণ্ড নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি আশা করছে, তখন তিনি ফের মৌন থেকেই বললেন, ‘সরকার ছুটছে।’ সরকার আসলে বিদেশে ছুটছে। কিন্তু এ দেশের মানুষের দুর্দশা কাটছে না।’’
মোদী-ঘনিষ্ঠদের অবশ্য দাবি, আদৌ মৌন নেই প্রধানমন্ত্রী। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিরোধী শিবির আর সংবাদমাধ্যমে যতই যতই বিতর্কের ঝড় উঠুক, তাঁর সরকার উন্নয়নের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়নি। অবশ্য তাঁরা বিলক্ষণ জানেন, ললিত-কাণ্ডকে হাতিয়ার করেই সংসদ অচলের চেষ্টা করবে কংগ্রেস। উপরন্তু সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছেন, সংসদের ভিতরে বিষয়ভিত্তিক ভাবে অন্য বিরোধী দলগুলির সঙ্গে তাঁরা সুর মেলাতেই পারেন। এই প্রসঙ্গে কেন্দ্রের এক শীর্ষস্থানীয় মন্ত্রী আজ বলেন, ‘‘আপাত ভাবে প্রধানমন্ত্রী বোঝাতে চেয়েছেন, সব কিছু স্বাভাবিক আছে। ঠিক যে ভাবে বসুন্ধরাকেও ‘স্বাভাবিক ভাবে’ দিল্লিতে আসার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিজেপি নেত্রীরা ইস্তফা না দিলে কংগ্রেস যে সংসদ চলতে দেবে না, তা স্পষ্ট।’’
স্বভাবতই কংগ্রেস-সিপিএমকে একঘরে করা গেলে বিরোধী আক্রমণের ঝাঁঝ যে অনেকটাই কমিয়ে দেওয়া যাবে, সেটা বুঝতে পারছেন বিজেপি নেতৃত্ব। এটাও বুঝছেন, প্রকাশ্যে নেতারা যতই ‘স্বাভাবিক’ আচরণ করুন, বাস্তব হল, সংসদের দুই কক্ষ মিলিয়ে ৬৫টি বিল আটকে। তাই তলায় তলায় বিরোধী জোটে ফাটল ধরাতে সক্রিয় হয়েছেন তাঁরা।
বিজেপি সূত্রের মতে, এই রণকৌশলে সরকারের লক্ষ্য হল, জয়ললিতা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুলায়ম সিংহ, মায়াবতী, নবীন পট্টনায়ক, শরদ পওয়ারের মতো আঞ্চলিক নেতা-নেত্রীদের সমর্থন আদায় করা। অরুণ জেটলি আমেরিকা থেকে ফিরেই এই বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একপ্রস্ত আলোচনা সেরেছেন। বিভিন্ন দলের সঙ্গে কথাও বলছেন তিনি। সংসদীয় মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডু আমেরিকা গিয়েছেন। সামনের মাসের ১০ তারিখে ফিরে এসে তিনিও এই আলোচনা প্রক্রিয়ায় সামিল হবেন। জয়ললিতার অনুরোধ মেনে ডিএমকে নেতা দয়ানিধি মারানের একটি চ্যানেলের অনুমোদন আটকে দিয়েছে কেন্দ্র। জয়ললিতা সম্প্রতি দুর্নীতি মামলায় রেহাই পেলেও কর্নাটক সরকার ফের তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছে। কিন্তু তার পরেও জয়ললিতার পাশে দাঁড়িয়ে কেন্দ্র তাঁকে নিঃশব্দে আইনি সাহায্য করছে বলে সরকারি সূত্রের দাবি।
এবং বিজেপি শিবিরের একাংশের বক্তব্য, নেপথ্যের এই তৎপরতার ফল ইতিমধ্যেই ফলতে শুরু করেছে। যেমন, সমাজবাদী পার্টির নেতা রামগোপাল যাদব সরাসরি সুষমা স্বরাজের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সপা-র এখন অবস্থানই হল, ‘মানবিক কারণে যে ভাবে ললিত মোদীকে সাহায্য করা হয়েছে, তা একেবারে যথার্থ। এতে কোনও অপরাধ নেই। রাজনীতিতে থাকলে এ ভাবে সহযোগিতা অনেক সময়ই করতে হয়।’ কংগ্রেস ও অন্য কিছু বিরোধী দল যে ভাবে এটিকে ‘তিল থেকে তাল’ করছে, বরং তারই সমালোচনা করেছে সমাজবাদী পার্টি। শরদ পওয়ারের এনসিপি-র নেতা মজিদ মেনন বলেছেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত কোনও ছোট ঘটনাতেও ললিত মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হয়নি। তা হলে তাঁকে ‘পলাতক’ বলা যায় কী করে?’’
আমেরিকা সফরে থাকাকালীন মমতার তারিফ করেছিলেন জেটলি। সুষমাকে নিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধার পর তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় সমালোচনার সুরে মুখ খুলেছিলেন। তড়িঘড়ি তৃণমূলের মুখপাত্র ডেরেক ও’ ব্রায়েনকে দিয়ে সেই মন্তব্য খণ্ডন করানো হয়। মমতা সরাসরি সুষমার পাশে না দাঁড়ালেও মোটামুটি নিরপেক্ষ অবস্থানই নিয়ে চলছেন। ও দিকে, নবীনের দলের নেতা ভত্রুহরি মেহতাব বলেছেন, ‘‘আমরা কংগ্রেসের সুরে সুর মেলাতে চাই না। উপযুক্ত সময়েই আমরা আমাদের অবস্থান জানাব।’’
কংগ্রেস নেতারা অবশ্য আত্মবিশ্বাসী। তাঁদের বক্তব্য, সংসদের অধিবেশন শুরু হতে এখনও অনেক দিন বাকি। অনেক বিরোধী দল এখনও পর্যন্ত নীরব ঠিকই। কিন্তু তাদের সিংহভাগই প্রকাশ্যে এসে বলছে না যে, তারা বসুন্ধরা-সুষমার পাশে রয়েছে। ফলে সংসদের ভিতরে যখন হল্লা হবে, তখন বিজেপির পাশে দাঁড়ানোটা এদের পক্ষে সহজ হবে না। তা ছাড়া কংগ্রেস সংসদ অচল করার কৌশল নিয়েছে। বিশেষ করে রাজ্যসভায়, যেখানে সরকার পক্ষ সংখ্যালঘু। ফলে সিংহভাগ বিরোধী দল যদি নীরব থাকেও, তবু সংসদ অচল করার পক্ষে কংগ্রেস সাংসদরাই যথেষ্ট। আর অন্যান্য দলের দু-চার জনকে পাশে পাওয়া গেলে তো কথাই নেই। ফলে কংগ্রেসের বক্তব্য, সরকার যতই অন্য বিরোধীদের কাছে টানার চেষ্টা করুক, তাতে লাভ হবে না। হট্টগোলে যদি ভোটাভুটিই পরিস্থিতিই না হয়, তা হলে বিল পাশ করাতে সমর্থন নিয়েও কোনও লাভ নেই।