স্মৃতি ইরানিকে এই চিঠি লিখেই বিতর্কে বন্দারু দত্তাত্রেয়।
আবার এক দলিতের অস্বাভাবিক মৃত্যু! এ বার এক ছাত্রের। আর তা নিয়ে ফের উত্তাল হয়ে উঠল দেশের রাজনীতি।
উত্তরপ্রদেশের দাদরিতে এলাকার কিছু মানুষ ‘গোমাংস’ রাখার গুজব রটিয়ে হত্যা করেছিল এক প্রৌঢ়কে। বিরোধীরা নরেন্দ্র মোদী সরকারের পরোক্ষ মদতের অভিযোগ তুললেও সে যাত্রা শাসক শিবিরের বড় কোনও নেতার নাম সরাসরি জড়ায়নি। এ ক্ষেত্রে ঘটনাটি আত্মহত্যার। হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে রোহিত ভেমুলা নামে এক ছাত্রের গলায় ফাঁস দেওয়া দেহ মিলেছে। পাওয়া গিয়েছে একটি ‘সুইসাইড নোট’-ও। তাতে কাউকেই দায়ী করা হয়নি। কিন্তু জড়িয়ে গিয়েছে কেন্দ্রীয় শ্রম ও রোজগার মন্ত্রী বন্দারু দত্তাত্রেয়র নাম। অভিযোগ, স্থানীয় সাংসদ হিসেবে তিনিই এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন যে ছাত্রটি এই চরম পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। বিরোধীরা তাই দত্তাত্রেয়র ইস্তফার দাবিতে মুখর হয়ে উঠেছে।
শুধু তাই নয়, মন্ত্রী দত্তাত্রেয়, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আপ্পা রাও, বিজেপির ছাত্র সংগঠন এভিবিপি-র স্থানীয় দুই নেতা সুশীল কুমার ও বিষ্ণুর বিরুদ্ধে তফসিলি পীড়ন প্রতিরোধ আইনে অভিযোগও দায়ের করেছে সাইবারাবাদ এলাকার গাচিবাউলি থানার পুলিশ। এই ঘটনার প্রতিবাদে হায়দরাবাদ-সহ দক্ষিণের বিভিন্ন শহর ছাড়াও দিল্লিতে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের দফতরের সামনে বিক্ষোভ দেখায় ছাত্র সংগঠনগুলি। ছাত্রদের সামলাতে প্রথমে লাঠি চালায় দিল্লি পুলিশ। পরে জলকামান।
গোটা ঘটনায় নতুন করে অস্বস্তিতে বিজেপি নেতৃত্ব। মোহন ভাগবতের সংরক্ষণ-বিরোধী মন্তব্য থেকে ভি কে সিংহের দলিত-বিরোধী মন্তব্যের সূত্রে বিজেপিকে দলিত-বিরোধী তকমা দিয়ে গত কয়েক মাস ধরে লাগাতার প্রচার চালাচ্ছে কংগ্রেস। আজ যেটা হয়েছে, তাতে সরাসরি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর নাম ও ঘটনা সংক্রান্ত মন্ত্রীর চিঠি সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যাওয়ায় বেজায় অস্বস্তিতে পড়েছে বিজেপি। দলের শীর্ষনেতারা এখন বিষয়টি এড়াতে পারলে বাঁচেন। আজ দুপুরে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ বলেন, ‘‘আমি এখনও কিছু শুনিনি।’’
বিতর্কের শুরু মুম্বই বিস্ফোরণে অন্যতম অভিযুক্ত ইয়াকুব মেমনের ফাঁসিকে ঘিরে। গত অগস্টে ওই ফাঁসির বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রতিবাদ মিছিল বার করে ‘অম্বেডকর স্টুডেন্টস ইউনিয়ন’। বিজ্ঞান বিভাগে পিএইচডি-র দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রোহিত তার সদস্য ছিলেন। এভিবিপি-র প্রতিনিধিরা ওই মিছিলের প্রতিবাদ জানালে দু’পক্ষের সংঘর্ষ বাধে। রোহিত-সহ ৫ ছাত্রের বিরুদ্ধে এভিবিপি-র স্থানীয় নেতা সুশীল কুমারকে মারধর করার অভিযোগ ওঠে। সাসপেন্ড করা হয় রোহিতদের। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি প্রাথমিক তদন্তে রোহিতদের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ পায়নি। ফলে তাঁদের সাসপেনশন তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু গত ডিসেম্বর মাসে নতুন করে রোহিতদের সাসপেন্ড করেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। রোহিতদের জানিয়ে দেওয়া হয়, ক্লাসরুম ও গবেষণাগার ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কোনও সুবিধা (ক্যান্টিন, হস্টেল ইত্যাদি) ব্যবহার করতে পারবেন না। এর প্রতিবাদে ছাত্রাবাসের সামনেই তাঁবু খাটিয়ে থাকছিলেন রোহিত-সহ পাঁচ জন। গত ২১ ডিসেম্বর সেই তাঁবু ভেঙে দেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। জানিয়ে দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই থাকতে পারবেন না রোহিতরা। এই মানসিক নির্যাতন ও সামজিক বয়কটের কারণেই রোহিত ভেঙে পড়েছিলেন, বলছেন তাঁর বন্ধুরা। কাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের ক্যাম্পাসে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন রোহিত।
প্রশ্ন হল, এ নিয়ে বন্দারুর দিকে কেন আঙুল তোলা হচ্ছে?
কংগ্রেস ও ছাত্র সংগঠনগুলির অভিযোগ, ‘অম্বেডকর স্টুডেন্টস ইউনিয়ন’-এর সদস্যদের ছাড় পেয়ে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেননি দত্তাত্রেয়। তিনি দোষী ছাত্রদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সতীর্থ স্মৃতি ইরানিকে চিঠি পাঠান। তাতে তিনি লেখেন, ‘‘হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় চরমপন্থী, অপরাধী ও জাতপাতের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। অম্বেডকর স্টুডেন্টস ইউনিয়নের পক্ষ থেকে যে ভাবে ইয়াকুব মেমনের ফাঁসির বিরোধিতা করা হয়েছিল, তা থেকেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এভিবিপির সভাপতি সুশীল কুমার ওই মিছিলের প্রতিবাদ করায় তাঁকে মারধর করা হয়। সবচেয়ে দুঃখের হল গোটা ঘটনাটি দেখেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়ে রয়েছেন।’’
সূত্রের খবর, ওই চিঠি পাওয়ার পরেই বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয় স্মৃতি ইরানির মন্ত্রক। অভিযোগ, তার পরেই নতুন করে সাসপেন্ড করা হয় রোহিতদের। এবং এর জেরেই রোহিত আত্মহত্যা করেন। কংগ্রেসের বক্তব্য, দত্তাত্রেয়কে অবিলম্বে সরাতে হবে। স্মৃতি ইরানির মন্ত্রকও এর দায় এড়াতে পারে না। ‘সুইসাইড নোট’-এ কোনও ব্যক্তির নাম না করা হলেও, রোহিতের পরিবারেরও অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে ভাবে রোহিত-সহ ৫ ছাত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার নামে কার্যত ‘সামাজিক বয়কট’ চাপিয়ে দিয়েছিলেন, তার জেরেই এই ঘটনা। ইতিমধ্যেই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ধর্নায় বসেছেন রোহিতের মা। আজ সকালে রোহিতের দেহ হস্টেলের ঘরে আটকে রেখে বিক্ষোভ দেখান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। পরে বিশাল পুলিশবাহিনী নিয়ে এসে দেহ উদ্ধার করে।
বিভিন্ন মহল থেকে ওঠা অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় বিজেপি মুখপাত্র কৃষ্ণসাগর রাও এ দিন বলেন, ‘‘ওই ছাত্রের আত্মহত্যা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। তবে আত্মহত্যার সঙ্গে ছাত্রদের সাসপেন্ড করার কোনও যোগ আমরা দেখছি না। এর সঙ্গে বন্দারু দত্তাত্রেয় বা স্মৃতি ইরানির কোনও সম্পর্ক নেই। এক ছাত্রের ব্যক্তিগত বিষয় টেনে এনে নিম্নমানের সুবিধাবাদী রাজনীতি করা হচ্ছে।’’
আর দত্তাত্রেয় কী বলছেন?
তাঁর বক্তব্য, ‘‘তদন্ত হলেই সব সত্য সামনে চলে আসবে।’’ ঘটনাটি খতিয়ে দেখতে দুই সদস্যের একটি দল গড়েছেন মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি। যদিও দত্তাত্রেয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থাকলে কেন্দ্রের গড়া দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারবে না বলে সরব হয়েছে কংগ্রেস। দলের মুখপাত্র আরপিএন সিংহ বলেন, ‘‘দত্তাত্রয়কে অবিলম্বে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেওয়া হোক। তা না হলে সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া সম্ভব নয়। গোটা ঘটনায় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক নিজের দায় এড়াতে পারে না। স্মৃতি ইরানির অবিলম্বে হায়দরাবাদ যাওয়া উচিত।’’