নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।
রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এবং রাজস্থানে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিজেপির প্রচার এবং প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মানসিকতা দলের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করল বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। সেই সঙ্গে এই প্রশ্নও উঠছে যে, বিজেপি রাজ্য নেতাদের মাথা তুলে রাখার দিন কি শেষ হতে চলেছে?
ভোটের মুখে দাঁড়ানো এই তিন রাজ্যের জনপ্রিয় বিজেপি নেতাদের যে ভাবে চকের দাগের বাইরে ঠেলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর পছন্দের তালিকাকে সামনে নিয়ে আসার কৌশল নিয়েছেন কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্ব, তাতে এই লক্ষণই স্পষ্ট হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। এতে স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে সংশ্লিষ্ট প্রদেশ বিজেপির অভ্যন্তরে।
সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশের দিনদৌরিতে মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্যের জনপ্রিয়তম নেতা শিবরাজ সিংহ চৌহান জনসভায় নিজেই একটি প্রশ্ন তোলেন। জনতার উদ্দেশ্যে তাঁর প্রশ্ন, “মামা কি মুখ্যমন্ত্রী হবেন না হবেন না?” স্বাভাবিক ভাবেই জনগর্জনে বুঝিয়ে দেওয়া হয় তাঁরা ‘মামা’ অর্থাৎ চৌহানকেই ফের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান। সূত্রের মতে, এই প্রশ্ন নেহাতই বাজার গরম করার জন্য করেননি ‘মামা’। তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেকেছেন সব মিলিয়ে প্রায় ১৭ বছর। কিন্তু এ বারে ভোটের আগে তাঁকে আবারও মুখ্যমন্ত্রী করা হবে কি না, তা নিয়ে বিজেপি নেতৃত্ব তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে নীরব।
রাজস্থান এবং ছত্তীসগঢ়েও বিজেপির চিত্রনাট্য অভিন্ন। এই দুই রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী যথাক্রমে বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া এবং রমন সিংহকে ভোটের প্রচারে এগিয়ে আনার কোনও উদ্যোগই দেখা যাচ্ছে না দলের শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে। শুধু তাই নয়, বিজেপির এই দুই প্রবীণ আঞ্চলিক নেতৃত্বকে অপ্রাসঙ্গিক করে দিতে কেন্দ্রীয় বিজেপির পছন্দসই কিছু সাংসদ এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে পাঠানো হচ্ছে প্রচারের দায়িত্ব সামলাতে। প্রচারের নেতৃত্ব দেবেন মোদী, এটা স্বয়ংসিদ্ধ। তাঁর নামেই ভোট চাওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। রাজ্যে রাজ্যে বিজেপির যাবতীয় নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির জন্য দেওয়া হচ্ছে ‘মোদী কা গ্যারান্টি’। নরেন্দ্র মোদী নিঃসন্দেহে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা এই মুহূর্তে। তাঁর বক্তৃতার শক্তিও সংশয়াতীত। কিন্তু রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের ধারণা, তিন রাজ্যে কংগ্রেসের তিন জন স্থানীয় নেতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রাজ্য বিজেপির মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করে (বসুন্ধরা রাজেকে শক্তিহীন করার জন্য যেমন জয়পুরের রাজপরিবারের এক প্রতিনিধিকে টিকিট দেওয়া হয়েছে) কিছুটা ঝুঁকিই নিয়ে ফেলেছেন মোদী-অমিত শাহ।
তবে রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, এটা বিজেপি ধারাবাহিক রাজনৈতিক কৌশলেরই অঙ্গ। যেখানে রাজ্য নেতৃত্বকে কিছুটা পিছনে সরিয়ে নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তিকেই বেশি করে সামনে নিয়ে আসা হয়। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মনে করছেন, আসন্ন লোকসভা ভোটেও সেটা ফল দেবে। রাজনৈতিক শিবিরের মতে, লালকৃষ্ণ আডবাণী গোটা দেশে বিজেপির একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরি করা শুরু করেছিলেন। এমন ভাবে সংগঠন সাজানো, যেখানে বিভিন্ন রাজ্যে শক্তিশালী নেতা তৈরি হবেন। উপরোক্ত তিন বর্তমান-প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তো বটেই, এমনকি খোদ নরেন্দ্র মোদী নিজেও এই উদ্যোগের ফসল। গুজরাতের একজন শক্তিশালী নেতা হিসাবেই তাঁর উত্থান। আডবাণীর জমানায় বিজেপির চেষ্টা ছিল, রাজ্য বিজেপি তথা প্রশাসনের দায়িত্ব একজন সুযোগ্য নেতার কাঁধে দেওয়া এবং তাঁর কৃতিত্বকে সামনে আনা। তাঁরা নিজ নিজ রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারে অবিসংবাদী নেতৃত্ব করেছেন এত দিন।
কিন্তু বদল আসতে শুরু করে ২০১৪ সালে মোদী সরকার দিল্লির মসনদে বসার পর। পর্যবেক্ষকদের মতে, ওই সময় থেকেই গোটা বিষয়টি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কুক্ষিগত হল। অনেকের মতে, গুজরাত লবির আধিপত্য বাড়ল মোদী এবং অমিত শাহের হাত ধরে। তাঁরাই হয়ে উঠলেন বিভিন্ন রাজ্যেও দলের শেষ কথা। ২০১৯-এর আগে বা পরে বিভিন্ন রাজ্যে বিধানসভা ভোটের প্রচারে গিয়ে মোদী নিজের নামে ভোট চেয়েছেন। বলেছেন, ‘‘কে দাঁড়িয়েছে দেখতে হবে না, আপনারা আমায় ভোট দিন।’’ হিমাচলেও তাই করেছিলেন মোদী। কিন্তু ফল ভাল হয়নি। কর্নাটকে বি এস ইয়েদুরাপ্পার মতো নেতাকে ক্ষমতাচ্যুত করার মূল্যও দিতে হয়েছে বিজেপিকে। স্থানীয় নেতাদের সরিয়ে ভোটে লড়ার পরিণাম নিয়ে প্রশ্ন তাই উঠছেই।
তবে বিজেপির একটি শিবিরের যুক্তি, একই মুখ বছরের পর বছর রাজ্যে থাকলে ভোটারদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার প্রবণতা এবং ক্ষোভ কেন্দ্রীভূত হয়। যে কারণে গুজরাতেও মুখ্যমন্ত্রী বদল করা হয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও মনে করা হচ্ছে, গুজরাত আর রাজস্থান-মধ্যপ্রদেশ এক নয়। এখানে কংগ্রেসের সঙ্গে কঠিন লড়াই বিজেপির।