দিল্লির বিজেপি কার্যালয়ে উদ্যাপন। ছবি: পিটিআই
এ লড়াই ছিল নরেন্দ্র বনাম নরেন্দ্রের। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার লড়াই। যে লড়াইয়ে গুজরাত আজ মোদীর পাশে থাকলেও, দিল্লি পুরসভার মতোই মোদীকে আজ খালি হাতে ফিরিয়েছে হিমাচলপ্রদেশ। তবে দিনের শেষে স্পষ্ট, নিজ রাজ্যে জেতার প্রশ্নে নাওয়া-খাওয়া ভুলে যে সর্বাত্মক প্রচারে নেমেছিলেন মোদী, তা পুষিয়ে দিয়েছে গুজরাতের মানুষ। ভূমিপুত্র নরেন্দ্র মোদীতেই আস্থা রেখেছেন তাঁরা।
অথচ পাঁচ বছর আগে, ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ম্যাজিক সংখ্যা টেনেটুনে পার করেছিল বিজেপি। ওই কষ্টার্জিত জয়, গুজরাতে বিজেপির শেষের শুরু কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। ফলে এ বারের লড়াই অনেকটাই ছিল নরেন্দ্র মোদীর নিজেকে নিজের রাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াই। যার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে। গোড়ায় ফি মাসে অন্তত এক বার করে গুজরাত সফর, শেষের দিকে প্রতি সপ্তাহে একাধিকবার গুজরাত সফর করেছেন মোদী। হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প ঘোষণা করেছেন গুজরাতের জন্য। বিরোধীদের অভিযোগ, প্রকল্প ঘোষণা যাতে করা সম্ভব হয়, তাই বিজেপির চাপে গুজরাতের ভোট ঘোষণা সাত দিনের বেশি পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয় নির্বাচন কমিশন।
তবে নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন মোদী। ১৮২ আসনের গুজরাত বিধানসভায় প্রায় তিন ডজন জনসভা করেছেন তিনি। করেছেন একাধিক রোড-শো। যে যাত্রার কোনওটির দৈর্ঘ্য ৩০ বা কোনওটির ৫০ কিলোমিটার। এমনকি, আমদাবাদে ভোট দিতে গিয়ে তিনি শোভাযাত্রা করে জনগণকে প্রভাবিত করেছেন, এমন অভিযোগে সরব হয়েছেন বিরোধীরা। সেই সঙ্গে এটাও ঠিক, এক বার আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, আর এক বার চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে গুজরাতে এনে ‘মহাশক্তিধর’ ভাবমূর্তি তৈরি করতে পেরেছেন মোদী, যাঁকে শেষ লগ্নে ‘রাবণ’ বলে দলের পায়ে বড় কুড়ুল মেরেছেন কংগ্রেসের নতুন সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে।
এ ছাড়া, দলের অভ্যন্তরীণ সংগঠন যাতে মসৃণ ভাবে কাজ করে, মোদী সেই দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন অমিত শাহের হাতে। ভোটের অন্তত দু’বছর আগে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপাণীকে মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে গোটা মন্ত্রিসভা ভেঙে দেন মোদী-শাহ জুটি। নতুন মুখ্যমন্ত্রী করা হয় ভূপেন্দ্র পটেলকে। সংরক্ষণ প্রশ্নে পটেল সমাজের অসন্তোষকে মাথায় রেখে এক দিকে ভূপেন্দ্রকেই মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে রেখে দেয় দল। অন্য দিকে পটেল সমাজের নেতা হার্দিক পটেলকে কংগ্রেস থেকে ভাঙিয়ে এনে টিকিট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ক্ষমতাশালী পটেল সমাজকে বার্তা দিতে প্রধানমন্ত্রী প্রচারে বলেন, ‘‘নরেন্দ্রের রেকর্ড যাতে ভূপেন্দ্র ভাঙতে পারেন, তার জন্য প্রাণপাত পরিশ্রম করবে নরেন্দ্র।’’ মোদী বোঝাতে চান, অতীতে যে সংখ্যক আসন জিতে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন, এ বার তার থেকে বেশি আসনে যেন দল জেতে, সেটিই তাঁর লক্ষ্য হতে চলেছে। বাস্তবে হয়েছে তাই। গুজরাতের ইতিহাসে ১৮২টির মধ্যে ১৫৬টি আসন জিতে রেকর্ড গড়েছে বিজেপি। মোদী আজ বলেন, ‘‘ভূপেন্দ্র যাতে রেকর্ড গড়ে জিততে পারেন, তার জন্য প্রাণপাত পরিশ্রম করেছি আমি।’’
তবে গুজরাত আঁচল ভরে দিলেও, মুখ ফিরিয়েছে দেবভূমি হিমাচলপ্রদেশ। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডার রাজ্যে লড়াই কঠিন ছিল গোড়া থেকেই। দলের একটি অংশ বলছে, অন্যান্য রাজ্যে সরকারের মেয়াদের মাঝপথে বা নিদেনপক্ষে ভোটের মুখে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থীকে পাল্টে দিয়ে প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়াকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে দেখা গিয়েছে বিজেপিকে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। রাজ্য নেতৃত্বের অতিরিক্ত আত্মতুষ্টি কাল হয়েছে বিজেপির। শেষ মুহূর্তে দলীয় বিধায়কদের মধ্যে থেকে ১৮ জনকে বসিয়ে দেন নড্ডরা। ডজনখানেক বিক্ষুব্ধ বিধায়ক ভোটে লড়েন। জিতেছেন তিন জন। বাকি চার জনের ভোট ভাঙানো কংগ্রেস প্রার্থীদের জয়লাভে সহায়ক হয়েছে। যদিও দলীয় কর্মীদের চাঙ্গা করতে গিয়ে আজ মোদী বলেন, ‘‘চড়াই-উতরাই আগেও এসেছে। ভবিষ্যতেও আসবে। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, হিমাচলে দল মাত্র ০.৯ শতাংশ ভোট কম পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছে। পার্থক্য সামান্য।’’