অতীতে প্রাক্তন কংগ্রেস নেতাদের সমর্থনের নজির টেনেছেন ইয়েচুরি। ফাইল চিত্র
বর্তমান ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতি’ই রাষ্ট্রপতি পদে যশবন্ত সিন্হাকে সমর্থন করিয়ে নিচ্ছে সিপিএমকে। তেমনই জানিয়েছেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি।
একে তো যশবন্ত এ সেদিনও তৃণমূলের সর্ব ভারতীয় সহ-সভাপতি ছিলেন! দ্বিতীয়ত, তিনি কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী। তা হলে বাংলায় বিজেপি এবং তৃণমূলের সঙ্গে সমান দূরত্ব রেখে চলার কথা বললেও সিপিএম যশবন্তকে সমর্থন করছে কেন? এই প্রশ্ন রয়েছে সিপিএমের অন্দরে-বাইরে। বস্তুত, এই প্রশ্নে খানিকটা বিড়ম্বনায়ও পড়েছে সিপিএম। নেটমাধ্যমে দলের সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীরাও নানা রকম টিপ্পনী করতে শুরু করেছেন। সম্ভবত সেই কারণেই তার জবাব দিয়েছেন ইয়েচুরি।
পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের দলীয় মুখপত্র ‘গণশক্তি’-কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে ইয়েচুরি যশবন্তকে সমর্থনের জন্য বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথাই উল্লেখ করেছেন। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাঁদের সিদ্ধান্তের মূল বাধ্যবাধকতা। প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘‘দুঃখজনক ভাবে পওয়ার (এনসিপি নেতা শরদ পওয়ার) রাজি হননি, তার পর ফারুক আবদুল্লা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাননি, পরিশেষে একেবারে শেষ মুহূর্তে গোপালকৃষ্ণ গাঁধীও অসম্মত হন। সেই পরিস্থিতিতে আমরা এমন নামের খোঁজ করছিলাম, যেখানে সর্বোচ্চ মতৈক্য হতে পারে। এই পরিস্থিতিতেই যশবন্ত সিন্হার নাম আসে।’’
কিন্তু যশবন্ত তো বিজেপির প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী! তার জবাব দিতে সিপিএমের পুরনো নজির তুলে ধরেছেন ইয়েচুরি। সে ক্ষেত্রেও পরিস্থিতির প্রয়োজনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল জানিয়ে বলেছেন, ‘‘অতীতে অনেক ক্ষেত্রেই সেই সময়ের সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে পার্টির ঘোষিত লক্ষ্যপূরণের জন্য এমন ব্যক্তিদের সমর্থন করা হয়েছে, যাঁরা কংগ্রেসের নেতা ছিলেন, পরে কংগ্রেস ছেড়ে দিয়েছেন। উদাহরণ স্বরূপ ইন্দিরা গাঁধী ও জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময়ে জগজীবন রাম যখন কংগ্রেস ভেঙে বেরিয়ে এলেন, আমরা তাঁকে সমর্থন করেছি। অন্যথায় সেই সময়ে জনতা পার্টির সরকার তৈরি হত না। তখনকার পরিস্থিতিতে সেটাই প্রয়োজন ছিল।’’ এমন আরও একটি পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে ইয়েচুরি বলেছেন, ‘‘ভি পি সিংহ রাজীব গাঁধী সরকারের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু দুর্নীতির প্রশ্নে তিনি যখন বেরিয়ে এলেন আমরা তাঁকে সমর্থন করেছি। পার্টির আশু লক্ষ্যপূরণের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হয়। এখন লক্ষ্য হল সংবিধান রক্ষা করা। এই লক্ষ্যপূরণের জন্য যিনি কাজ করবেন, আমাদের সমর্থন পাবেন।’’
পরিস্থিতি যে সত্যিই সিপিএমের অনুকূলে নেই, তা উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। ১১ বছর আগেও বাংলাই ছিল সিপিএমের বড় শক্তিস্থল। সেই বাংলাতেই কোনও সাংসদ বা বিধায়ক নেই দলের। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের ঝুলিতে শূন্য ভোট। আরও বড় ধাক্কা যে, সিপিএম তথা বামেদের ক্ষমতা থেকে হটানো তৃণমূলের প্রস্তাবিত প্রার্থী যশবন্তকেই সমর্থন দিতে হচ্ছে। যার ব্যাখ্যা সিপিএমের একাংশ বলছে— কার্যত তৃণমূলের ‘কৌশলের’ কাছে পরাস্ত হতে হয়েছে সিপিএমকে। তবে ইয়েচুরি তৃণমূলের দলীয় পদ থেকে যশবন্তের ইস্তফা দেওয়াকে ‘নৈতিক জয়’ হিসেবেই দেখছেন। তাঁর কথায়, ‘‘তৃণমূল অন্যদের কৌশলে পরাস্ত করেছে, এ কথা একেবারেই সত্য নয়। বরং উল্টোটা। যশবন্ত সিন্হাকে (দলীয় পদ থেকে) ইস্তফা দিতে হবে, এ কথা মেনে নিতে তারা বাধ্য হয়েছে।’’
বামেরা কেন আলাদা প্রার্থী দেওয়ার কথা ভাবল না? এই প্রশ্নের উত্তরে ইয়েচুরি বলেছেন, ‘‘এখন সেই পরিস্থিতি নেই। বামপন্থীরা স্বাধীন ভাবে ভোটে দাঁড়ালে বামপন্থীদের আরও শক্তিক্ষয় হত, বিজেপি সরকার এবং হিন্দুত্ব সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী ঐক্যকে ব্যাহত করা হত। এতে বামপন্থীদের বিচ্ছিন্নতা বাড়ত। আজকের পরিস্থিতিতে তা একেবারেই সঠিক হত না।’’
ঘটনাচক্রে, তৃণমূলের প্রার্থীকে মেনে নেওয়া নিয়ে সিপিএমের যেমন ‘অস্বস্তি’, তেমনই বিজেপি তথা এনডিএ-র প্রার্থী দ্রৌপদী মুর্মুকে নিয়ে অন্য ‘বিড়ম্বনায়’ তৃণমূলও। দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতি হিসাবে তিন জনের নাম বিবেচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি লিখেছিলেন। নাজমা হেপতুল্লা, দ্বিতীয় বারের জন্য প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কথা বলার পাশাপাশি চিঠিতে দ্রৌপদীর কথাও লিখেছিলেন তিনি। সেই চিঠি প্রকাশ্যে আসার পর কুণাল বলেছেন, ‘‘এক একটি সময়ের এক এক রকম প্রেক্ষিত থাকে। ২০১৭ সালে কোনও নাম সামনে আসার আগে আমি ঐক্যমত্যের জন্য এই নামগুলি লিখেছিলাম।’’ তবে এখন তিনি যশবন্তকেই রাষ্ট্রপতি দেখতে চান জানিয়ে কুণাল বলেন, ‘‘সংবিধান অটুট রাখবে যে শক্তি, সেই শুভ শক্তিকেই জেতানো দরকার। ফলে ব্যক্তি দ্রৌপদী নন, বিরোধীদের প্রার্থী যশবন্ত সিন্হা রাষ্ট্রপতি হলে দেশের মঙ্গল।’’
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।