Telangana Assembly Election 2023

পুরনো শহরের আবেগেও অস্বস্তি গেরুয়া হাওয়ার

সমীক্ষা যা-ই বলুক, বিজেপির প্রদেশ সভাপতির দাবি, ২০২০-র পুরভোটে বিজেপি যেমন ভাল ফলাফল করেছিল, এ বারের ভোটেও তার পুনরাবৃত্তি হবে।

Advertisement

অগ্নি রায়

হায়দরাবাদ শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৭:০৩
Share:

শুনশান চারমিনারের চারপাশ। বৃহস্পতিবার তেলঙ্গানায়। ছবি: পিটিআই।

যখন ক্যালকাটা কলকাতা হয়, মাদ্রাজ চেন্নাই, বম্বে হয় মুম্বই, তখন তো কোনও প্রশ্ন ওঠে না। এখন এই শহরের নাম ভাগ্যনগর করতে চাওয়া হচ্ছে বলে এত প্রশ্ন! তেলঙ্গানায় বিধানসভা ভোটের দিনেও কিছুটা ক্ষোভ, কিছুটা প্রচার এই মর্মে মিলিয়ে-মিশিয়ে দিলেন বিজেপি নেতৃত্ব। যদিও দিনের শেষে বুথ-ফেরত সমীক্ষা ইঙ্গিত দিচ্ছে, ভোটযন্ত্রে সেই প্রচার বিশেষ দাগ কাটতে ব্যর্থ।

Advertisement

শহরের এক পাঁচতারা হোটেলের একটি তলা নিয়ে নিজেদের তাঁবু গেড়েছে বিজেপি। এটিই আপাতত দলের মিডিয়া সেন্টার। তেলুগুতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা তেলঙ্গানার বিজেপি সভাপতি জি কিষণ রেড্ডি, যার এক বিন্দুও বুঝতে পারিনি। অগত্যা বেরোতেই সওয়ার হয়েছিলাম তাঁর গাড়িতে, রেড্ডির পরবর্তী গন্তব্য জুবিলি হিলস-এর একটি বুথ পর্যন্ত। যাত্রাপথের আলাপচারিতায় উপরোক্ত যে ক্ষোভের কথা বলছিলেন তিনি, তার সূচনা করে গিয়েছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী, এখানে তিন বছর আগে পুরভোটের প্রচারে এসে।

“কেন এই শহরের নাম হায়দরাবাদ থাকবে বলুন তো? এটাই তো ইতিহাস-বিকৃতি। হায়দর আলি এক অত্যাচারী শাসক। ভাগ্যনগরই ছিল এই শহরের আসল নাম। সেটাই আমরা ফিরিয়ে আনব জেতার পরে”, বলছেন কিষণ রেড্ডি। জয়ের ব্যাপারে তিনি এতটা আত্মবিশ্বাসী কী ভাবে, যেখানে এত দিন বিজেপির কোনও হাওয়াই হাটে-বাজারে চর্মচক্ষে দেখা গেল না? বরং এই গুঞ্জনই ছিল সর্বত্র যে, বিআরএস-এর সঙ্গে তলে তলে হাত মিলিয়ে কংগ্রেসের সম্ভাবনাকে ভোঁতা করে দেওয়াটাই তেলঙ্গানায় নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহের লক্ষ্য— যাতে চব্বিশের লোকসভা ভোটেও বেশি আসন না পায় কংগ্রেস। কিষণ রেড্ডির পাল্টা জবাব, “কেসিআর (কে চন্দ্রশেখর রাও) যে ভাবে মজলিশ পার্টি (এমআইএম)-র জো হুজুরি করছেন, তাঁর সামনে আমরা মাথা নত করব, এটা ভাবলেন কী করে? কংগ্রেস আর বিআরএস, উভয়েই দুর্নীতিবাজ। এরা দু’জনে মিলে তেলঙ্গানাকে লুটেছে।” কিন্তু কেসিআর-এর কন্যা কবিতার বিরুদ্ধে আবগারি দুর্নীতি নিয়ে তো কোনও পদক্ষেপ নেই। তাঁকে তো গ্রেফতার করা হচ্ছে না আপ নেতা-মন্ত্রীদের মতো? কিষণ রেড্ডির উত্তর, “কোন মূর্খ এটা বলেছে? যা তদন্ত হওয়ার হচ্ছে। আপাতত সুপ্রিম কোর্ট স্থগিতাদেশ দিয়ে রেখেছে।’’

Advertisement

সমীক্ষা যা-ই বলুক, বিজেপির প্রদেশ সভাপতির দাবি, ২০২০-র পুরভোটে বিজেপি যেমন ভাল ফলাফল করেছিল, এ বারের ভোটেও তার পুনরাবৃত্তি হবে। কিন্তু স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের মতে, এ শুধু কথার কথা। ২০২০ সালের হায়দরাবাদের পুরভোট এবং আজকের বিধানসভা ভোটের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। প্রথমত, পুরভোট শুধু শহরকেন্দ্রিক বিষয়। দ্বিতীয়ত, সেই ভোট হয়েছিল হায়দরাবাদে বিরাট বন্যার পরে। এমন বৃষ্টি হয়েছিল হায়দরাবাদ সংলগ্ন অঞ্চলে, যা গত একশো বছরে দেখা যায়নি। ফলে ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে রাগে ফুটছিলেন শহরবাসী। বিজেপির প্রতি প্রেম নয়, ওই ভোট ছিল জনতার ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ এবং বিআরএস-কে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জেদ। সেই জন্যই সে বার কমল চিহ্নে ছাপ পড়েছিল বেশি। কিন্তু এই ক্ষোভকে নিজেদের দিকে টানতে ব্যর্থ হয়েছিল কংগ্রেস।

নাম বদলানোর রাজনীতির পাশাপাশি প্রচার-পর্বে পুরনো হায়দরাবাদ শহরের হাল ফেরানো নিয়েও মুখর থেকেছেন এখানকার বিজেপি নেতৃত্ব। কিষণ রেড্ডিই বলেছিলেন, “পুরনো শহরে এক বার ঘুরে আসুন। কোনও নিকাশি ব্যবস্থা নেই। লেখাপড়ার সুবিধা নেই। আমরা জিতে এলে এই জায়গার বিকাশের জন্য ঝাঁপাব। কংগ্রেসের মতোই নিজের পরিবারের বিকাশের জন্য কাজ করেছেন কেসিআর।” কংগ্রেস তাদের ইস্তাহারে দাবি করেছিল, ক্ষমতায় এলে সংখ্যালঘুদের সংরক্ষণ দেবে চাকরিতে। এই বিষয়টি নিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল বিজেপি। তাদের বক্তব্য, ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সংবিধানেই নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বিজেপির অভিযোগ, গত সত্তর বছরে কংগ্রেস নিজেদের আখের গোছাতে মুসলিমদের ব্যবহার করেছে। পিছন থেকে ছুরি মেরেছে তাঁদের।

পুরনো হায়দরাবাদ অর্থাৎ বেগম বাজার ছাড়িয়ে ওসমানগঞ্জে যখন গিয়েছিলাম, তখন প্রথমেই নাকে ধাক্কা মেরেছিল রসুন, পেঁয়াজ আর আদার মিশ্র গন্ধ। গোটা শহরের মধ্যে ওই তিন বস্তুর সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার এখানেই। এর পর মুসি নদী পার হতেই মদিনা সেন্টার মার্কেট। সোজা রাস্তা চলে গিয়েছে আলো ঝলমল চারমিনারের দিকে। মানচিত্র উল্লেখের কারণ একটাই— এই রাস্তার প্রতি পদে আতর, কাচের চুড়ি বা পোশাক বিক্রেতা ছোট-বড় নানা দোকানের মালিকের সঙ্গে আলাপচারিতায় বিজেপি দূরস্থান, বিআরএস-এরও নামগন্ধ পাওয়া যায়নি। “শুধু ভোটের সময় নয়, (আসাদুদ্দিন) ওয়েইসি গোটা বছরই এখানে আসেন। আমাদের আগলে রেখেছেন। ওঁর বাবা, ‘সালার-ই-মিল্লাত’ সুলতান সালাউদ্দিনের সময় থেকেই এই পরিবারের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ”, বলেছিলেন স্থানীয় ব্যবসায়ী আনিসুর শেখ। তাঁর অভিযোগ, বিজেপি এখানে ভোটের প্রচার করতেও আসে না কোনও বার।

চশমা থেকে ফলের বিশাল বাজারের ভোট দশকের পর দশক ধরে ওয়েইসির দলই পেয়ে আসছে। আজকের পরেও তার অন্যথা হওয়ার কোনও কারণ দেখা যাচ্ছে না। তবে পর্যবেক্ষকদের অনুমান, জেলায় গ্রামে-গঞ্জে মুসলিম ভোট কিছুটা হলেও কাড়তে পারছে কংগ্রেস। তার কারণ, মুসলিম সম্প্রদায়ের একাংশের মধ্যে এই বিশ্বাস ঢুকে গিয়েছে যে, বিআরএস আসলে দিল্লিতে বিজেপিরই ধামা ধরে চলছে। বিআরএস-কে ভোট দেওয়া মানে নরেন্দ্র মোদীর হাতই শক্ত করা। এ সবের চূড়ান্ত প্রতিফলন কি বিধানসভা ভোটেই মিলবে, না চব্বিশের লোকসভায়? এখন অপেক্ষা উত্তরের।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement