সুশান্ত সিংহ রাজপুত। ফাইল চিত্র।
তিনি কোথায়!
না পোস্টারে, না ব্যানারে, না প্রচারে— কোথাও নেই তিনি। অথচ, কিছু দিন আগেও রাজ্যের নির্বাচনী প্রচারের অন্যতম বিষয় ছিলেন তিনি। কিন্তু বিহার যখন প্রথম দফা নির্বাচন শেষ করে দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের দিকে পা বাড়িয়েছে, তখন নেতা থেকে কর্মী সকলেই নীরব অভিনেতা সুশান্ত সিংহ রাজপুত ও তাঁর মৃত্যুরহস্য নিয়ে। শাসক শিবির তো বটেই, সিবিআই তদন্তের দাবি প্রথমেই তোলা আরজেডি প্রধান তেজস্বী যাদবও মুখে কুলুপ এঁটেছেন সুশান্ত-প্রশ্নে।
রাজপুত অধ্যুষিত বক্সারে এক সময়ে সহানুভূতির ঝড় উঠেছিল সুশান্তকে কেন্দ্র করে। সেই কারণে তাঁর মৃত্যুকে সামনে রেখে রাজপুত ভোট নিজেদের ছাতার তলায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়েছিল শাসক-বিরোধী উভয় জোটই। রাজ্য জুড়ে রব উঠেছিল ‘জাস্টিস ফর সুশান্ত’। কিন্তু যাবতীয় হিসেব গুলিয়ে দেয় এমসের চূড়ান্ত মেডিক্যাল রিপোর্ট। সেখানে বলা হয়, আত্মহত্যাই করেছেন সুশান্ত। বক্সারের ডুমারিয়া চকে বিজেপির দলীয় কার্যালয়ে বসে থাকা হরপ্রসাদ উপাধ্যায়ের দাবি, সুশান্তের বিরুদ্ধে ‘নেশা করার অভিযোগ’ গোড়া থেকেই ছিল। কিন্তু মৃত্যু ঘিরে একাধিক প্রশ্ন আগ্রহী করে তুলেছিল বিহারবাসীকে। কিন্তু এমসের রিপোর্ট সে সবে জল ঢেলে দিয়েছে।
প্রচারের জন্য বিজেপি দফতরের সামনে দাঁড়িয়ে অন্তত গোটা বিশেক ই-রিক্সা। আলোচনা শুনে এগিয়ে এলেন তারই একটির চালক, বছর তিরিশের অজয়। তাঁর মতে, “সুশান্ত যে বিহারের ছেলে, সেটা ওর মৃত্যুর আগে কত জন জানত, সন্দেহ আছে। বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি হওয়ায় এত হল্লা হয়েছে।’’
আরও পড়ুন: শিবসেনার হাত ধরে ফের রাজনীতিতে ঊর্মিলা, বিধান পরিষদে মনোনীত করছেন উদ্ধব
লকডাউনের সময়ে উত্তরপ্রদেশ থেকে কার্যত পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরেছেন অজয় ও তাঁর সঙ্গীরা। এ হেন অজয়ের সাফ কথা, “কত লোক হেঁটে বাড়ি ফিরতে গিয়ে মারা গেল, তাদের নিয়ে প্রচার হোক।’’ বিব্রত হরপ্রসাদও স্বীকার করে নেন, লকডাউনে পরিযায়ীদের দুর্দশা নিয়ে আলোচনার পরিবর্তে যে ভাবে সুশান্তকে নিয়ে রাজনীতি হয়েছে, তাতে পরিযায়ীদের একটি বড় অংশ ক্ষুব্ধ। বিজেপি সূত্রের মতে, তাই সচেতন ভাবেই আলগোছে ব্রাত্য করে দেওয়া হয়েছে সুশান্তকে।
পটনা থেকে দানাপুর হয়ে মসৃণ হাইওয়ে দিয়ে বক্সারের দিকে যত এগিয়েছি, দেখেছি, প্রায় প্রতিটি রাজপুত অধ্যুষিত এলাকাই আর সুশান্ত নিয়ে মাথা ঘামাতে নারাজ। দানাপুরের স্থানীয় গাড়ি চালক
ব্রজেশ কুমার জাতিতে রাজপুত। একনিষ্ঠ আরজেডি কর্মী। এক সময়ে তিনিও ‘জাস্টিস ফর সুশান্ত’-এর নামে মিছিল-শোভাযাত্রা করেছেন। কিন্তু এখন তাঁর কথায়, “প্রথমে রহস্য মৃত্যু হয়েছে বলে ভেবেছিলাম। কিন্তু পরে জানলাম আত্মহত্যা। ফলে কারও কিছু বলার নেই। তা ছাড়া, এখানে স্থানীয় পর্যায়ে এত সমস্যা রয়েছে, সেগুলি সামনে আসা বেশি প্রয়োজন।’’
সুশান্ত-প্রসঙ্গ প্রচারে প্রভাব ফেলবে না বুঝেই এখনও পর্যন্ত মাত্র একটি জনসভায় এ নিয়ে সরব হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। অক্টোবরের গোড়ায় প্রথম অনলাইন জনসভায় তিনি বলেন, সুশান্তের মৃত্যুরহস্য উন্মোচনে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। এমনকি, সুশান্তের মৃত্যুর পরে যে তেজস্বী যাদব বিহারের আর এক অভিনেতা শেখর সুমনের সঙ্গে যৌথ সাংবাদিক বৈঠক করে সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়েছিলেন, নীরব তিনিও। তাঁর দল আরজেডি-র নেতা আব্দুল বারি সিদ্দিকি বলেন, “রাজপুত ভোটব্যাঙ্ক আমাদের বড় ভরসা হলেও, কারও মৃত্যুকে সামনে রেখে ভোট চাওয়া হবে না বলেই দল সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’’ ঘনিষ্ঠ মহলে সব দলের নেতারাই বলছেন, সুশান্ত বিহারের ভূমিপুত্র হতে পারেন। কিন্তু ‘নেশা তাঁর পতনের কারণ’ বলে মনে করছেন বিহারবাসী। তাই তাঁকে সামনে রেখে ভোট চাইলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
সুশান্ত প্রশ্নে ‘ধোঁকা খেয়েছেন’ বিহার পুলিশের সদ্য প্রাক্তন ডিজি গুপ্তেশ্বর পাণ্ডে। ঘনিষ্ঠ মহলে গুপ্তেশ্বর দাবি করেন, ‘দবং’ সিনেমার চুলবুল পাণ্ডে তাঁর আদলেই তৈরি। সুশান্ত মৃত্যু তদন্তে এই গুপ্তেশ্বরকে দিয়েই মহারাষ্ট্র পুলিশের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল নীতীশ প্রশাসন। মুম্বইয়ে যাওয়া বিহারের পুলিশ দলের সঙ্গে উদ্ধব ঠাকরের সরকার অসহয়োগিতা করেছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। সুশান্তকে ঘিরে ‘বিহারি অস্মিতা’ উস্কে দেওয়ার প্রাথমিক কাজটুকু সেরে ভোটের আগে ইস্তফা দেন গুপ্তেশ্বর। ঘনিষ্ঠ মহলে দাবি করেন, বক্সার থেকে তাঁকে প্রার্থী করবে বলে আশ্বাস দিয়েছে শাসক জোট। কিন্তু গুপ্তেশ্বরের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি। ইস্তফা দেওয়ার পরে নীতীশ নাকি আর তাঁর সঙ্গে দেখাও করেননি। বক্সারে বিজেপি দাঁড় করিয়েছে বিহার পুলিশের প্রাক্তন কনস্টেবল, সঙ্ঘের একনিষ্ঠ কর্মী পরশুরাম চতুর্বেদীকে।
সূত্রের মতে, গুপ্তেশ্বর প্রার্থী হলে তাঁর বিরুদ্ধে বদলা নিতে শিবসেনা প্রার্থী দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতায় এমনিতেই অস্বস্তিতে এনডিএ। তাই নতুন করে আর লড়াই কঠিন করতে চাননি নীতীশ। মুখ্যমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ শিবিরের মতে, সুশান্তকে ঘিরে হাওয়া নেই বুঝেই কোপ পড়ে গুপ্তেশ্বরের উপর। তা ছাড়া, তাঁর অতিরিক্ত মিডিয়াপ্রীতি, বিতর্কিত মন্তব্য করার অভ্যাস থাকায় বাড়তি বিতর্ক ঘাড়ে নেওয়ার ঝুঁকি নিতে চাননি নীতীশ। ফলে ভোট বাজারে সুশান্তের মতোই উধাও গুপ্তেশ্বরও। ক্ষোভে গা-ঢাকা দিয়েছেন তিনি।
গোটা বিহারে সামান্য হলেও সুশান্ত উপস্থিত তাঁর পৈতৃক জেলা গোপালগঞ্জে। সুশান্তের তুতো ভাই, গোপালগঞ্জের বিজেপি বিধায়ক নীরজ সিংহ বাবুলকে এ বারেও টিকিট দিয়েছে দল। যদিও একই সঙ্গে নির্দেশ দিয়েছে, সুশান্ত নিয়ে প্রচার করলে কোনও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না, তা বুঝে নিয়ে তবে এগোতে।