কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে দেওয়াল লিখন। —নিজস্ব চিত্র
‘‘স্যর, আমি তো জানতেই পারিনি, কবে পরীক্ষা ছিল। বাস-অটো চলছিল না। কী করে ইউনিভার্সিটি আসব? যখন-তখন পাথর ছোড়া হচ্ছে বলে আম্মি-আব্বু বাড়ি থেকে বার হতেই দিচ্ছেন না। আমাদের মহল্লায় নিউজপেপারও আসছে না। পরীক্ষা দিতে না-পারলে তো একটা বছর নষ্ট হয়ে যাবে!’’
‘ফ্যাকাল্টি অব ল’-এর ডিন অধ্যাপক মহম্মদ হুসেনের সামনে দাঁড়িয়ে কেঁদেই ফেললেন আইনের ছাত্রীটি। হুসেন সান্ত্বনা দিলেন, ‘‘একটা দরখাস্ত দিয়ে যাও। এমন অনেকেরই হয়েছে। দেখি কী করা যায়!’’
কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়। হজরতবাল মসজিদের পাশেই কর্ণ জোহর-আদিত্য চোপড়ার সিনেমার লোকেশনের মতো ক্যাম্পাস। চিনার-দেওদারে ঘেরা সবুজ ঘাসের কার্পেট। স্নাতকোত্তর স্তরে প্রায় ৮ হাজার ছাত্রছাত্রী। কিন্তু ভূস্বর্গের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে হু হু করে হিমেল হাওয়া বইলেও ছাত্রছাত্রীদের হট্টগোল নেই।
আরও পড়ুন: জেএনইউয়ে ফের আজাদি বিতর্ক
ফাইনাল পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল অগস্টে। হঠাৎ ৫ অগস্ট ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ হয়ে গেল। তার পর থেকেই কাশ্মীরে কার্ফু। ইন্টারনেট বন্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসও বন্ধ। ক্লাস, পরীক্ষা বন্ধ। হোস্টেল বন্ধ। কার্ফু ওঠায় অক্টোবর থেকে পরীক্ষা নেওয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু ইন্টারনেট, এসএমএস বন্ধ বলে ছাত্রছাত্রীরা খবরই পাচ্ছেন না কবে পরীক্ষা। কবে থেকে ক্লাস শুরু হবে, কেউ জানেন না।
আইনের ছাত্রীটি চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে যাওয়ার পরে হুসেন হতাশ গলায় বললেন, ‘‘কত ছাত্রছাত্রী বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য আবেদন করেছিল। সুযোগ পেল কিনা, দেখার উপায় নেই। আমার কাছে হয়তো ছাত্রছাত্রীদের জন্য সুপারিশ চেয়ে বিদেশের ইউনিভার্সিটির ই-মেল এসে পড়ে রয়েছে। কিন্তু দেখতেই তো পারছি না।’’
কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের সব থেকে বড় দুই বিভাগ— ‘ফ্যাকাল্টি অব ল’ এবং ‘বিজনেস স্কুল’। এমবিএ-র পড়ুয়াদেরও একই অবস্থা। বিভাগীয় প্রধান মুস্তাক আহমেদ দারজি বললেন, ‘‘এখন পড়াশোনা, গবেষণা, সবটাই ইন্টারনেট নির্ভর। আমরা নোট তৈরি করে দিচ্ছি। ছাত্রছাত্রীরা বাড়িতে বসে পড়ছে। কিন্তু অসুবিধা তো হচ্ছেই।’’
বিভাগের বাইরে ঘুরঘুর করছিলেন এমবিএ-র চূড়ান্ত বর্ষের এক ছাত্র। ‘‘এ বছর তো একটাও ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ হল না। কোনও কোম্পানিতে যোগাযোগ করতে পারছি না। ৩৭০ রদ হয়ে আমার কেরিয়ার বরবাদ হয়ে গেল!’’ এ কথা বলার পরেই অনুরোধ, ‘‘নামটা লিখবেন না। তা হলে জীবনটাই বরবাদ হয়ে যাবে।’’
ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট কাজ করছে না। রেজিস্ট্রার নিসার আহমেদ মির প্রশাসনকে অনুরোধ করেছিলেন, অন্তত উপাচার্যের দফতরে যেন ইন্টারনেট চালু থাকে। তা-ও হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখপাত্র অধ্যাপক শাহিদ রসুল বলেন, ‘‘আমরা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি। অগস্ট মাসে যে সব পরীক্ষা ছিল, সেগুলি নেওয়া হচ্ছে। খবরের কাগজে, কেবল চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে নতুন পরীক্ষার তারিখ জানিয়ে। কিন্তু যাঁরা দূর-দূরান্তে থাকেন, অনেকেই খবর পাচ্ছেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলিতে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ। কলেজগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা হচ্ছে।’’ আবার ক্লাস কবে শুরু হবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন। মুখ খোলা মানা। জবাব মেলে, প্রশাসনকে প্রশ্ন করুন। প্রশাসন কি চায় কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হোক?
প্রশাসন জানে, ক্লাস শুরু হলেই ছাত্রছাত্রীদের জটলায় উঠে আসবে ৩৭০ রদের প্রশ্ন। তর্কবিতর্ক, উত্তপ্ত বাদানুবাদ হবে। উপত্যকায় জমে থাকা ক্ষোভের আগুন আছড়ে পড়তে পারে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। পরীক্ষা শুরু হতেই ক্যাম্পাসের দেওয়ালে ‘আজাদি’ লেখা দেখা দিয়েছে। অতএব লেখাপড়া শিকেয় তুলে রাখাই মঙ্গল।
কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ? রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রবীণ অধ্যাপক গুল ওয়ানি জবাব দেন, ‘‘যখন মানুষের জীবনযাত্রাই প্রশ্নের মুখে, তখন পড়াশোনা কি আর অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকে? কাশ্মীরে এখন নীরবতার সংস্কৃতি, ভয়ের সংস্কৃতির বীজ বপন হচ্ছে। সেটাই ভবিষ্যৎ।’’