নজরদারি। ছবি: এপি।
জায়গায় জায়গায় শুধু স্থানীয়দের কিছু খুচরো জটলা। রাস্তায় উর্দিপরা সেনা দেখামাত্র সেই ভিড়ও নিমেষে পাতলা হয়ে গেল। দক্ষিণ কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলার আরিহাল গ্রামে আজকের ছবি। রুটিন টহল নয়, লিফলেট বিলি করছে বাহিনী। ১১ দফা যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছে— সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫এ অনুচ্ছেদ বদলে কী কী লাভ হবে উপত্যকার! কিন্তু সে সব শুনতে চাইছে কে? বাহিনী সরতেই আবার জটলা। সেখানে অসন্তোষ— ‘‘সব লোকদেখানো। সকালে লিফলেট বিলি করছে, আর রাতে বাড়ি-বাড়ি হানা দিয়ে ছেলে-বুড়ো-মেয়েদের উপর অত্যাচার করছে উর্দিপরারা।’’
উর্দুতে ছাপানো লিফলেট বলছে, ‘সুদিন’ আসছে জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখে। কেন্দ্রীয় শিক্ষার অধিকার আইনে উপত্যকার সবাই স্কুলে যাবে। মিড-ডে মিল পাবে। স্বাস্থ্যে ‘আয়ুষ্মান’, নতুন হাসপাতালের কথাও বলছে লিফলেট। কিন্তু কানই দিতে চাইছেন না এলাকার লোকেরা।
প্রশাসন দেখাতে চাইছে, সব স্বাভাবিক। কিন্তু সংবিধানের অনুচ্ছেদ বাতিল পর্ব শুরু হওয়ার তিন সপ্তাহ পরেও অচলাবস্থা বহাল বেশির ভাগ অংশে। কেন্দ্রের সঙ্গে অঘোষিত অহযোগিতা আন্দোলন এবং সামাজিক অবাধ্যতার পথেই হাঁটছে জম্মু-কাশ্মীর। দক্ষিণের পুলওয়ামা থেকে উত্তরের বারামুলা, মধ্য কাশ্মীরের শ্রীনগর থেকে বদগাম— সর্বত্র বন্ধ দোকানপাট। কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দিয়ে স্কুল খোলানো যাচ্ছে না। সরকারি অফিস-কাছারিতে লোক নেই।
কেন্দ্রের বিরুদ্ধে অসন্তোষ জানাতে কার্যত এই বন্ধের চেহারা উপত্যকায় নতুন নয়। ২০০৮, ২০১০, ২০১৬-য় অবিকল এমনই ছবি ছিল। শোনা যায়, হুরিয়ত-সহ অন্য বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের নেতারা ‘ক্যালেন্ডার’ ছাপিয়ে বন্ধ পালনের হুলিয়া দিতেন স্থানীয় ব্যবসায়ীদের। কিন্তু এ বার নেতারাও ধৃত কিংবা গৃহবন্দি। ফোন নেই, নেট ফেরেনি উপত্যকায়।
তা হলে এই সার্বিক ‘অসহযোগিতা’ আর ‘অবাধ্যতা’-র নেতৃত্ব দিচ্ছেন কে? অচলাবস্থার ২৩তম দিনে শ্রীনগরের দোকানমালিক শাহিদ ইকবাল বললেন, ‘‘এ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ। ওরা (কেন্দ্র) আমাদের থেকে সব কেড়ে নিয়েছে। তবু কিছু বলা যাবে না!’’
কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক গুল মহম্মদ বলছেন, ‘‘পরিস্থিতির ফায়দা নিতে পাকিস্তান মুখিয়ে রয়েছে। তাই কেউ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিলে বুঝতে হবে, তার মাথায় ইসলামাবাদের হাত আছে।’’ আবার কাশ্মীর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক ইফরাজ আহমেদের কথায়, ‘‘মানুষই স্বেচ্ছায় ঘরবন্দি।’’
তবে রাস্তায় একজোট হলেই জনতা সুর চড়াচ্ছে বাহিনীর বিরুদ্ধে। পুলওয়ামার এক যুবক বললেন, ‘‘রাত ১২টা থেকে ১টার মধ্যে আসছে ওরা। সঙ্গে পুলিশও আনছে না। বাড়ি-বাড়ি ঢোকার আগে মসজিদের মাইকগুলো বন্ধ করে দিচ্ছে, যাতে বাইরের কেউ কিচ্ছুটি না টের পায়।’’ আরিহাল গ্রামের তরফে অভিযোগ, ২৭ জুলাই এবং ৩ ও ৪ অগস্ট অন্তত ২০০টি গাড়ি ভাঙচুর করেছে বাহিনী। যদিও বাহিনী সব অভিযোগ
অস্বীকার করেছে।
সিআরপিএফের এডিজি জুলফিকার হাসান আজই জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যপাল সত্য পাল মালিকের সঙ্গে দেখা করেন। রাজভবন সূত্রের খবর, বাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করে রাজ্যপাল আগামী দিনেও কড়া নজরদারি চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন। মাঝখানে খবর ছড়িয়েছিল, রাজ্যপাল নাকি আটক প্রাক্তন দুই মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা এবং মেহবুবা মুফতির মুক্তির ব্যাপারে তদ্বির করছেন। নেতাদের শর্ত দেওয়া হয়েছে, ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল নিয়ে তাঁরা যেন মন্তব্য না-করেন। সেই খবর ‘ভুয়ো’ বলে মন্তব্য করেছেন রাজ্যপালের মুখপাত্র।