পাঁচ বছর আগেকার সেই রাতটা ভুলতে পারে না বছর বারোর কিশোর নুরুল ইসলাম। সেই রাত তার জীবন আমূল পাল্টে দিয়েছিল। সেই রাতের পরে মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ ছেড়ে নুরুলের পরিবারকে পাড়ি দিতে হয়েছিল বাংলাদেশ।
ছেলেটার বয়স তখন মাত্র সাত। কিন্তু জঙ্গিরা কী ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাদের বাড়ির উপরে, তার প্রতিটা মুহূর্ত স্পষ্ট মনে আছে ওর। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে প্রথমে ঠাঁই বাংলাদেশে। তার পরে সেখানে আশ্রয় না জোটায় ভারতে চলে আসা। ‘‘অবস্থা খুব খারাপ ছিল। বাবার অত টাকা ছিল না। ভারতে আসার আগে টানা কত দিন না খেয়ে ছিলাম, জানি না। ভারতে এসে বাবা মাছ বিক্রি করা শুরু করল। কোনওমতে বাঁচার শুরু,’’ গাল বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে যায় নুরুলের। রোহিঙ্গা মুসলিম পরিবারের এই কিশোর এখন দক্ষিণ দিল্লির শাহিন বাগে এক শিবিরের বাসিন্দা। সেখানে ৭০ জনের ঠাঁই। তার মধ্যে আছে নুরুলের পরিবারও।
দিল্লিতে অন্তত ১২০০ রোহিঙ্গার বাস। শাহিন বাগ ছাড়াও অনেকে রয়েছেন এখানকার মদনপুর খাদারে। একবার নিজেদের দেশের রাখাইন প্রদেশ থেকে বাস গুটিয়ে চলে আসতে হয়েছে। তার পর কখনও বাংলাদেশ। কখনও ভারত। এখন নুরুলের মতো অনেকের কাছে ঘর মানে আবর্জনার স্তুপের পাশে খাটানো একটা তাঁবু। কিন্তু মাথার উপরে সেই টুকরো কাপড়টাও এখন থাকবে কিনা প্রশ্ন উঠেছে। আগামিকাল সুপ্রিম কোর্টে এই নিয়ে একটি আবেদনের শুনানি হবে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের মায়ানমারে ফেরত পাঠানোর ভারতের সরকারি সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে ওই আবেদন এসেছে শীর্ষ আদালতে। তাই রাত পোহালেই সে দিকে নজর থাকবে ওঁদের।
কারণ মায়ানমারে ফিরে যাওয়া ওঁদের কাছে বিভীষিকা ছাড়া আর কিছুই নয়। নুরুল যেমন বলল, ‘‘এখানে ভাল আছি। স্কুলে যেতে ভাল লাগে। কোনও দিন দেশে ফিরতে চাই না। ওখানে সেনা তো বাচ্চাদের মেরে ফেলে। এখানকার সরকারকে অনুরোধ, আমাদের ফিরিয়ে দেবেন না।’’ অন্য শরণার্থী শিবিরগুলোতেও একই দশা। ফেরার কথা ভাবলেই শিউরে উঠছেন অনেকে। একুশের তরুণী শাবিকুন নাহার বলছেন, ‘‘সারা জীবন শরণার্থী হয়ে থাকতে চাই না। কিন্তু নিজের গ্রামে ফেরার কথা ভাবলেই সেনা হামলার ভয়ঙ্কর স্মৃতি তাড়া করে।’’ বলে চলেন শাবিকুন, ‘‘আমাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। বৌদ্ধ ধর্ম মানতে বাধ্য করেছিল। স্থানীয় মসজিদে যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছিল। এত ভয় পেতাম যে রাতে ঘুম আসত না।’’ নুরুলের মতো শাবিকুনও ঘর ছাড়েন ২০১২ সালে। স্বজনদের নিয়ে প্রথমে বাংলাদেশ। এক বছর থাকার পরে সেখানে অসম্ভব দারিদ্রের সঙ্গে আর লড়তে না পেরে তরুণী চলে আসেন ভারতে। এখানে বিয়ে আর এক রোহিঙ্গা শরণার্থী মহম্মদ জুবেইরকে (৩০)। দিল্লির এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় কাজ করেন জুবেইর। তাঁর আয়ে সংসার টানতে যত কষ্টই হোক, দেশে ফেরার দুঃস্বপ্নের কাছে তা কিছুই নয়।
শাহিন বাগ শিবিরেই আছেন শাবিকুন। তাঁর কথায়, ‘‘এখন পরিস্থিতি আরও খারাপ। দয়া করে সবাই আমাদের পাশে দাঁড়ান। বাংলাদেশে বাবা-মা আছেন। এখন দিল্লি থেকে তবু ওঁদের ফোন করতে পারি। কিন্তু এই সরকার তাড়িয়ে দিলে সেটাও বন্ধ হয়ে যাবে।’’ দিল্লিতেই ছোট্ট মুদি দোকান চালান আব্দুল রহিম। ন’বছর আগে মায়ানমার ছেড়েছেন। কিন্তু খোঁজ নেই ভাইয়ের। বাংলাদেশে এখনও পৌঁছয়নি ভাইয়ের পরিবার। এইটুকুই জানেন আব্দুল। বললেন, ‘‘দেশে ফেরার চেয়ে মরে যাওয়া ভাল।’’
রোহিঙ্গা মুসলিমদের অধিকার রক্ষার কাজ করেন শবির। ২৩ অগস্ট বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে চিঠি লিখেছেন তাঁরা। উত্তর পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। সরকার কেন তাঁদের ফেরাতে চায়, প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। দিল্লি ছাড়াও জম্মু, হায়দরাবাদ, হরিয়ানা, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশের কিছু কিছু অংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন অন্তত ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী। কাল সুপ্রিম কোর্টের শুনানির পরে কী হবে? ভাবনায় শবিররা।