শহরের এক হোটেলে লেখক অমিতাভ ঘোষ। শনিবার। নিজস্ব চিত্র
বাংলায় কলকারখানার অভাব, আর্থিক দারিদ্র আছে। ‘‘কিন্তু একটা বড় সম্পদও আছে, সে দিকে আমরা নজর দিচ্ছি না। তার নাম জল,’’ বললেন অমিতাভ ঘোষ। ‘শ্যাডোলাইন্স’, ‘সার্কল অব রিজন’-এর লেখক তাঁর নতুন উপন্যাস ‘গান আইল্যান্ড’-এর আনুষ্ঠানিক প্রকাশ উপলক্ষে সম্প্রতি ঘুরে গেলেন শহরে। শনিবার সকালে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বাংলার জলসম্পদের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে গেলেন তিনি।
কলকাতার ছেলে অমিতাভের নতুন উপন্যাস বিশ্বজোড়া জলবায়ু পরিবর্তনের পটভূমিতে। যে পরিবর্তন তামিলনাড়ু, তেলঙ্গানা, মহারাষ্ট্র, গুজরাত-সহ অর্ধেক ভারতে নিয়ে এসেছে শোচনীয় খরা-পরিস্থিতি। ‘‘জলবায়ু পরিবর্তনে ভারত সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থানে,’’ বলছিলেন লেখক। অবস্থা এমন যে, কেরল তামিলনাড়ুকে ২০ লক্ষ লিটার পানীয় জল দেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিল। এই বাস্তবতায় নদীমাতৃক বঙ্গদেশকে ভাগ্যবান মনে হয়, তাকে অন্তত জল কিনে খেতে হয় না। সেই প্রসঙ্গেই তিনি বললেন, ‘‘পাকিস্তান, বাংলাদেশ নিয়ে অর্ধেক উপমহাদেশে যা জলসঙ্কট, বাংলা সেখানে ভাগ্যবান।’’
কিন্তু ভাগ্য আর কত দিন? তাঁর নতুন উপন্যাসে ইতালিতে বেআইনি বাংলাদেশি অভিবাসীদের কথা আছে। সেখানে আর এক জলজ শহর ভেনিসে আইসক্রিম, বেলুনবিক্রেতা থেকে রেস্তোরাঁ কর্মীদের কথাবার্তায় কান পাতলেই ভেসে আসে বাংলা শব্দ। ‘‘ওই বাংলাদেশিরা অনেকেই আমাকে বলেছিলেন, ফরাক্কা প্রকল্পের পর জল না পাওয়া থেকেই তাঁদের দুর্দশা শুরু, দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন,’’ জানালেন লেখক।
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে বেআইনি অভিবাসনের সম্পর্ক প্রবল। সিরিয়া, তুরস্ক থেকে দলে দলে বিপন্ন মানুষ যে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে আসার চেষ্টা করেন, তার অন্যতম কারণই মরুভূমির ক্রমবর্ধমান মানচিত্র। এই মরুতৃষ্ণা মানবসৃষ্ট। কয়েক বছর আগে এক ব্রিটিশ সাংবাদিক তামিলনাড়ুতে একটি দৃশ্য দেখেছিলেন। জলসেচে বিদ্যুৎ মেলে নিখরচায়, ফলে তামিলনাড়ুর কিছু অঞ্চলে কৃষকেরা সারা দিন পাম্প চালিয়ে ভূগর্ভস্থ জল তোলেন। ট্যাঙ্কারে চেপে সেই জল পাড়ি দেয় মাদুরাই, কোয়ম্বত্তূরে। এক জনকে বলা হল, ‘‘ভাই, আপনারা যা করছেন, ভূগর্ভের জল তো ফুরিয়ে যাবে।’’ তাঁর উত্তর, ‘‘কিন্তু আমি না করলেও অন্যরা করবে। তা হলে আমি লাভ ছেড়ে দেব কেন?’’
জলবায়ু পরিবর্তন, মরুভূমির আগ্রাসী বিস্তার এবং বেআইনি অভিবাসনের পাশাপাশি এই উপন্যাসে অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো বয়ে চলেছে মনসা ও চাঁদ সদাগরের উপাখ্যান। আছে বাংলাদেশের ভোলা, সুন্দরবনের আয়লার কথা। লেখককে মনে করানো গেল, আকবরের সভাসদ আবুল ফজলের কথা। ১৫৮৪ সালে বঙ্গদেশের বাখরগঞ্জে ভয়াবহ এক ঝড়ের কথা লিখে গিয়েছেন তিনি। একমত লেখক— ‘‘মুঘলরা অনেক পরিবেশ-সচেতন ছিল। বাগিচা, দিঘি থেকে জলের প্রাসাদ অনেক কিছু করেছিল। কিন্তু ইউরোপ উপনিবেশ থেকে শুধু অর্থ আদায় করে গিয়েছে, পরিবেশ নিয়ে বিশেষ ভাবেনি।’’
আর সেখানেই আধুনিকতার ট্র্যাজেডি। পৃথিবীকে জাতিরাষ্ট্রের বয়ান শিখিয়েছিল ইউরোপ। অমিতাভের মনে হয়েছে, উষ্ণায়নের মোকাবিলায় এই জাতিরাষ্ট্রের বয়ান থেকেই বেরিয়ে আসতে হবে। ‘‘রোহিঙ্গা শুধু মায়ানমারের সমস্যা, বা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসা উদ্বাস্তুদের জন্য সীমান্তে কাঁটাতার তুললেই বেঁচে থাকবে ভারত, এমন ভাবা বাতুলতা। দরকারে সার্ক বা রাষ্ট্রপুঞ্জ আলোচনায় বসুক।’’
সুদূরপরাহত স্বপ্ন? অমিতাভ কিন্তু বাস্তবটা দেখিয়ে দিয়ে গেলেন। বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নবজাগরণের পাশাপাশি বাঙালিকে আর একটি সম্পদও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। জল!
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।