তিনি নেই। আবার তিনি আছেনও। না থেকেও তিনি ‘পাহারা’ দিয়ে চলেছেন দেশের সীমান্ত। এমনই বিশ্বাস ভারতীয় সেনাবাহিনীর একাংশের। তাঁদের কাছে হরভজন সিংহ দেবতা। মৃত্যুর বহু বছর পরেও যিনি সব বিপদ থেকে রক্ষা করে চলেছেন দেশকে এবং প্রহরারত সেনা-জওয়ানদের।
হরভজন সিংহের জন্ম ১৯৪৬ সালের ৩০ অগস্ট। গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক পাঠের পরে তিনি পঞ্জাবের ডিএভি হাইস্কুল থেকে পড়াশোনা করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি সেনাবাহিনীর পঞ্জাব রেজিমেন্টে যোগ দেন।
১৯৬৮ সালে ২২ বছর বয়সি হরভজন কর্মরত ছিলেন নাথু গিরিপথ বা নাথু লা-য়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে ১৪ হাজার ফুট উচ্চতায় দুর্গম ও সঙ্কীর্ণ এই গিরিপথ তার কয়েক বছর আগেই সাক্ষী ছিল ইন্দো-চিন যুদ্ধের।
যুদ্ধ পরিস্থিতি না থাকলেও সিকিম ও তিব্বতের মাঝে নাথু লা অবস্থানগত দিক দিয়ে সবসময়েই স্পর্শকাতর। সীমান্তবর্তী এই অংশেই মালবাহী পশুর পিঠে পণ্য নিয়ে হরভজন সিংহ রওনা দিয়েছিলেন প্রত্যন্ত ও দুর্গম আউটপোস্টের পথে। সেখানে রসদের অপেক্ষায় অন্য সেনা জওয়ানরা।
সেটা ছিল ১৯৬৮-র অক্টোবর। কয়েক দিন ধরেই নাথু লা সীমান্তে বৃষ্টি ও ধসে প্রতিকূল ছিল পরিস্থিতি। তার মধ্যেই রওনা দেন হরভজন সিংহ। কিন্তু গন্তব্যে আর পৌঁছনো হয়নি।
যে ভারবাহী পশুগুলিকে তিনি নিয়ে যাচ্ছিলেন, তাদের মধ্যে কয়েকটি ফিরে আসে সেই আউপোস্টে, যেখান থেকে হরভজন সিংহ রওনা দিয়েছিলেন। তাঁর সহকর্মীরা বুঝতে পারেন, হরভজনের কোনও বিপদ হয়েছে।
শুরু হয় তাঁর সন্ধানে তল্লাশি। কিন্তু তিন চার দিন ধরে তাঁর নির্ধারিত যাত্রাপথে তন্ন তন্ন করেও হরভজনের কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি। জনশ্রুতি, তার পর নিহত হরভজন নিজেই বলে দেন কোথায় পাওয়া যাবে তাঁর নিথর দেহ।
তিনি নাকি স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন আর এক সেনা জওয়ান প্রীতম সিংহকে। প্রচলিত বিশ্বাস, হরভজনের বলে দেওয়া নির্দিষ্ট স্থানেই পাওয়া গিয়েছিল তাঁর নিথর দেহ।
তাঁর মৃত্যুর কারণের বিষয়ে আর কোনওদিনই কিছু জানা যাবে না। তবে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য করা হয়।
মৃত্যুর পরেও নাকি নিজের কর্তব্যে অবিচল হরভজন সিংহ। তিনি নাকি শত্রুপক্ষ থেকে আসা আগাম বিপদের ব্যাপারে আগে থেকেই সতর্ক করেন সেনা জওয়ানদের। এমনকি, কোনও সেনার পোশাক সামান্যও অবিন্যস্ত থাকলে তাঁর গালে নাকি শূন্য থেকে উড়ে এসে পড়ে সপাট থাপ্পড়!
হরভজন সিংহের নিজের সামরিক উর্দি, জুতো সবই এখনও সযত্নে সংরক্ষিত। পরিপাটি করে রাখা আছে তাঁর ব্যবহৃত বিছানাও। কিন্তু নাথু লায় পাহারারত জওয়ানদের দাবি, মাঝে মাঝেই সেই পরিপাটি এলোমেলো হয়ে যায়। তাঁদের বিশ্বাস কাজের মাঝে হরভজন সিংহ নিজেই এসে বিশ্রাম নেন সেখানে।
‘তিনি’ যে ‘টহল’ দেন, সে প্রমাণ নাকি পাওয়া যায় তাঁর জুতোজোড়া থেকেও। সে দু’টিতে নাকি মাঝে মাঝেই ধুলোকাদা লেগে থাকে। অথচ তাঁর সামরিক উর্দির পরিচ্ছন্নতা একচুলও এ দিক ও দিক হয় না। কিংবদন্তি বলে, সিপাই হরভজন নিজেই তাঁর উর্দি পরিষ্কার রাখেন।
পূর্ণিমার রাতে চরাচর ভেসে যাওয়া দুধসাদা বরফের মাঝে নাকি ঘোড়ার পিঠে টহল দিতে দেখা যায় তাঁর ছায়ামূর্তিকেও। তাঁর উপস্থিতি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করতে পেরে নাথু লা-য় অভিনব উদ্যোগ নেওয়া হয়।
ঠিক করা হয়, মন্দির তৈরি করে রক্ষা করা হবে তাঁর স্মৃতি। তত দিনে তিনি দেবত্বের মর্যাদা পেয়ে গিয়েছেন। সেনাকর্মী থেকে তিনি তখন বাবা হরভজন সিংহ। সেই পরিচয়ই বহন করছেন এখনও।
গ্যাংটক থেকে ৫২ কিমি দূরে, নাথু আর জেলেপ গিরিপথের মাঝে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩ হাজার ১২৩ ফিট উচ্চতায় আছে বাবা মন্দির। পর্যটকরা সেখানে যান। রীতি হল, জলের বোতল রেখে আসার। সেই জলপান করলে নাকি পূর্ণ হয় মনের ইচ্ছে।
শুধু পর্যটকরাই নন। ট্রাক থামিয়ে পুজো দেন সেনা জওয়ানরাও। তাঁদের কাছে হরভজন সিংহ পূর্ণমাত্রায় সক্রিয় এবং রক্ষাকর্তা।
১২ বছর আগে পর্যন্ত প্রতি বছর নিজের বার্ষিক ছুটিও পেতেন বাবা হরভজন সিংহ। ১১ সেপ্টেম্বর তাঁর জিনিসপত্র নিয়ে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন পৌঁছত জিপ। সেখান থেকে ট্রেনে করে সেই জিনিস যেত পঞ্জাবের কপূরথালা জেলার কোকে গ্রামে। সেখানেই থাকেন তাঁর পরিজনরা।
এ ভাবেই ‘ঘরের ছেলে’ ফিরে যেতেন ‘ঘরে’। আবার ছুটি ফুরিয়ে গেলে ফিরে যান কাজের জায়গায়। তবে তাঁর আর কাজের জায়গায় বদলি হয় না। ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি ‘কর্মরত’ নাথু লা-য়।
হরভজন সিংহের নামে রিজার্ভেশন করা হত। ট্রেনের শূন্য বার্থে অন্য জওয়ানের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে যেতেন ‘সিপাই হরভজন সিংহ’। সঙ্গে যেত তাঁর জিনিসপত্র। তবে ১২ বছর হল এই রীতি বন্ধ করা হয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে।
সম্প্রতি একটি শর্ট ফিল্ম ‘প্লাস মাইনাস’ ফিরিয়ে এনেছে বাবা হরভজন সিংহের স্মৃতি। নিজের গ্রামে তিনি শহিদের মর্যাদা পান। ভারত-চিন সীমান্তে আবার উত্তেজনার পরিবেশে আরও এক বার আলোচনায় ফিরে এসেছেন তিনি।