সংসদে শীতকালীন অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মঙ্গলবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: এপি।
লোকসভা ভোটের বাকি এখনও কয়েক মাস। কিন্তু তার আগেই থেমে গেল বেশ কিছু দিন ধরে ঠোক্কর খেতে খেতে চলা নরেন্দ্র মোদীর বিজয়রথ! এবং এই প্রথম বড় ধাক্কা খেল মোদীত্ব নামক শব্দবন্ধটি। সেই ধাক্কাটা দিলেন রাহুল গাঁধী। মোদী-জমানায় প্রথম বার হিন্দি-বলয়ের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে বিজেপিকে হারালেন তিনি। কংগ্রেস সভাপতি পদে নাম ঘোষণার ঠিক এক বছর পূর্ণ হওয়ার দিনেই রাহুলের এই বিজয়। পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটের ফলে সেই অর্থে মোদীর বিজেপির হাতে রইল শূন্য। যদিও রাত পর্যন্ত মধ্যপ্রদেশ নিয়ে রহস্যই তাদের কাছে একমাত্র আশার আলো। রাতে টুইটারে হার মেনে কংগ্রেসকে অবশ্য অভিনন্দন জানালেন মোদী।
লোকসভার আগে এই পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটকে ধরা হয় সেমিফাইনাল। এ দিন কংগ্রেস অবশ্য মিজোরামে ক্ষমতা হারিয়েছে। তেলঙ্গানাতেও চন্দ্রবাবু নায়ডুর সঙ্গে তাদের জোট কাজে এল না। বিধানসভা ভেঙে দিয়ে ভোট এগিয়ে আনার চালেই সেখানে সফল হলেন চন্দ্রশেখর রাও। কিন্তু গোটা দেশের চোখ আজ যে দিকে ছিল, সেই হিন্দি-বলয়ের রাজস্থান এবং ছত্তীসগঢ়ে বিজেপিকে হারিয়ে ক্ষমতায় ফিরল কংগ্রেস। যদিও মাত্র দু’টি আসনের জন্য রাজস্থানে কংগ্রেস একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল না। আর হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে মধ্যপ্রদেশে রাত পর্যন্ত ম্যাজিক সংখ্যার নীচেই থেকে গিয়েছে দু’দল। সেখানেও সরকার গড়া নিয়ে নিশ্চিত কংগ্রেস। কারণ, অখিলেশ, মায়াবতীর দল সেখানে আসন পেয়েছে, যা সরকার গড়ার অন্যতম চাবি হয়ে উঠেছে।
গত কাল পর্যন্ত মোদীর প্রধান সেনাপতি অমিত শাহ বড় মুখ করে বলছিলেন, সব রাজ্যেই জিতবে বিজেপি। সকালে সংসদে গেলেও ভোটের ফল স্পষ্ট হওয়ার পরে তাঁকে আর দেখা যায়নি। রাতে টুইট করে তেলঙ্গানায় জয়ের জন্য চন্দ্রশেখর রাওকে ধন্যবাদ জানালেও তিন রাজ্যের হার নিয়ে টুঁ শব্দ করেননি বিজেপি সভাপতি! আর সারা দিন চুপ থেকে রাতে টুইট করে মোদী বললেন, হারজিত থাকেই। কংগ্রেসকে অভিনন্দন জানালেন। এবং সেই সঙ্গেই তেলঙ্গানা, মিজোরামের উল্লেখ করে মোদী নিজেদের এমন দুর্দিনেও কংগ্রেসকে তাদের ব্যর্থতার কথা মনে করিয়ে দিলেন!
আরও পড়ুন: মোদীর কাছেই শিখেছি কী করা উচিত নয়: রাহুল
এবং রাহুল গাঁধী। গত সাড়ে চার বছর ধরে মোদী ও তাঁর সঙ্গীদের মুখে লাগাতার ‘কংগ্রেস-মুক্ত ভারত’ কথাটি শুনছিলেন। মোদী ও তাঁর সঙ্গীদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপও কম সহ্য করতে হয়নি তাঁকে। তার মধ্যেই নিঃশব্দে নিজের মতো করে দল ও সংগঠন সাজিয়ে মোদীর প্রিয় শব্দটিকে উল্টে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করলেন। মোদী-শাহের এত দিনের দম্ভ চুরমার করে ঊনিশটি রাজ্য থেকে তিনটি প্রায় খসিয়ে দিলেন। কিন্তু রাহুল নিজে অবশ্য স্পষ্ট বললেন, ‘বিজেপি-মুক্ত ভারত’ গড়া তাঁর দর্শন নয়। মোদীর সঙ্গে ফারাকটি বুঝিয়ে বললেন, ‘‘লড়াই চলবে, কিন্তু কাউকে দেশ থেকে মুছে ফেলা আমাদের লক্ষ্য নয়। মোদীই আমাকে শিখিয়েছেন, কী করতে নেই।’’ তিন রাজ্যের বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রীকে আলাদা করে তাঁদের কাজের জন্য ধন্যবাদও জানালেন।
রামের নাম, রামের রথ, গরুর জন্য মন্ত্রী, হিন্দুত্বের হাওয়াতেও খোদ হিন্দি-বলয়ে বিজেপির এমন হাল কেন? দলের নেতারা বলছেন, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়ে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা ছিলই। মানুষ বদলও চাইছিলেন। বেকারি এবং কৃষক অসন্তোষ ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল। সেই রোষেই উড়ে গেলেন ছত্তীসগঢ়ের রমন সিংহ। মধ্যপ্রদেশেও তার ছাপ পড়েছে। তবে সেখানে অনেকটাই সামলানো গেছে শিবরাজ সিংহ চৌহানের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি এবং সাংগঠনিক শক্তির সাহায্যে। রাজস্থানে গত দু’দশক ধরে এমনিতেই প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সরকার বদল হচ্ছে। তার উপরে ছিল ‘মহারানি’ বসুন্ধরা রাজের বিরুদ্ধে ক্ষোভ। ফলে রামের নামেও সেখানে বালি ভেজেনি। শেষ মুহূর্তে গেরুয়া বাহিনী এবং মোদী সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপালেও হার সামাল দিতে ব্যর্থই।
আরও পড়ুন: বাজিটা শেষ অবধি মারল কে? মধ্যরাতেও উত্তপ্ত ভোপাল
তিন রাজ্যে ক্ষমতা হারানোর পরে বিজেপির এখন কপালে অগুন্তি ভাঁজ। কারণ তেলঙ্গানা বা মিজোরামেও তাদের লাভ হয়নি। এক সময়কার জোটসঙ্গী এমএনএফ মিজোরামে জেতার আগেই জানিয়ে দিয়েছে, তারা বিজেপির হাত ধরবে না। তেলঙ্গানার চন্দ্রশেখর রাও একই কথা জানিয়েছেন। ফলে বিজেপির অন্দরে এখন নানা প্রশ্ন। এই ফল কি মোদীর বিরুদ্ধে জনমত? যে ২২ কোটি পরিবারে মোদীর প্রকল্পের সুফল পৌঁছেছে, তা কি দাগ কাটল না? মন্দির রাজনীতি যে কাজে আসেনি, তা-ও স্পষ্ট। উল্টে বিরোধী শিবিরে হাত শক্ত হল রাহুলের। মোদীর প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠলেন তিনিই। তা হলে লোকসভায় কী হবে? রাহুল গাঁধী বলছেন, আসল কথাটি হল, কৃষক, যুবদের ক্ষোভ ধরতেই পারেননি প্রধানমন্ত্রী। উল্টে নোটবন্দি, জিএসটি করে আমজনতার হাল আরও বেহাল করেছেন। এই ফল সেই ক্ষোভেরই প্রতিফলন।