Coronavirus Lockdown

‘অন্যের থেকে সাহায্য চাইতে তাঁদের আত্মসম্মানে বাধে’

ঘটনাচক্রে দেশের মধ্যে সব থেকে বেশি গরিব, ভবঘুরে রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গেই (৮১ হাজার ২৪৪ জন)। তার পরেই রয়েছে উত্তরপ্রদেশ (৬৫ হাজার ৮৩৫ জন) ও অন্ধ্রপ্রদেশ (৩০ হাজার ২১৮ জন)।

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০২০ ০৬:০২
Share:

মুখ চেয়ে: বাবুঘাটে ত্রাণের অপেক্ষায়। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

বারাণসী থেকে শঙ্কর (নাম পরিবর্তিত) ফোন করেছিলেন কলকাতার সঞ্জীব সেনকে। অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের পরে শঙ্কর তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘বাড়িতে বসে আছি। দোকান বন্ধ। কিছু টাকা হবে?’’ বাবা-মা এবং স্ত্রী, দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে ছ’জনের সংসার শঙ্করের। লকডাউনের কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ রয়েছে তাঁর ফুলের দোকানটি।

Advertisement

সরকারি কর্মচারী সঞ্জীব বলছেন, ‘‘ওঁর সঙ্গে যে ক’দিনের পরিচয়, তাতে এটুকু বুঝেছি নিতান্তই প্রয়োজন না হলে শঙ্কর টাকা চাইতেন না।’’ সঞ্জীবের কথায়, শঙ্কর তাঁকে এ-ও বলেছিলেন, লোকলজ্জার কারণে তিনি স্থানীয় কারও থেকে সাহায্য চাইতে পারেননি। তাই ভিন্ রাজ্যের বন্ধুর দ্বারস্থ হয়েছেন।

অবশ্য বর্তমান পরিস্থিতিতে এমনই লক্ষাধিক শঙ্কর সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন। কোভিড-১৯ এক ঝটকায় যাঁদের ‘দিন আনি-দিন খাই’-এর আব্রু সরিয়ে ‘সাহায্যপ্রার্থী’-র সারিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টস’-এর ফেলো তিলোত্তমা মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, আসলে করোনা-পরিস্থিতি তথাকথিত দারিদ্রের সংজ্ঞাটাই পাল্টে দিয়েছে। অর্থনৈতিক ভাবে তো বটেই, মানসিক ভাবেও। তিলোত্তমার কথায়, ‘‘অনেকে অর্থও চাইছেন না। কেউ দু’কেজি আটা বা একটু চাল কিনে দিতে বলছেন। গরিব বলতে যা বুঝি এঁরা কেউই কিন্তু তা নন। শুধু টিকে থাকার জন্য সাহায্য চাইতে বাধ্য হচ্ছেন ওঁরা।’’

Advertisement

আরও পড়ুন: লকডাউন সফল, বৈঠকে দাবি মোদীর

এক অর্থনীতিবিদ বলছেন, ‘‘আমাদের অনেকেই কখনও না কখনও অর্থসাহায্য চান। কিন্তু সেই চাওয়ার সঙ্গে এই পরিস্থিতির একটা মৌলিক তফাত রয়েছে। এখন যাঁরা সাহায্য চাইছেন, তাঁরা নিজেরাই জানেন না, এই চাওয়ার শেষ কোথায়! এতটাই অনিশ্চিত আর্থিক ভবিষ্যৎ।’’

কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে মহিলা-পুরুষ মিলিয়ে গরিব, ভবঘুরের সংখ্যা হল ৪ লক্ষ ১৩ হাজার ৬৭০ জন। ঘটনাচক্রে দেশের মধ্যে সব থেকে বেশি গরিব, ভবঘুরে রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গেই (৮১ হাজার ২৪৪ জন)। তার পরেই রয়েছে উত্তরপ্রদেশ (৬৫ হাজার ৮৩৫ জন) ও অন্ধ্রপ্রদেশ (৩০ হাজার ২১৮ জন)।

আরও পড়ুন: শহরে রেকর্ড সংক্রমণ, বেসরকারি ক্ষেত্রে শয্যা বৃদ্ধির প্রস্তাব

বিশেষজ্ঞদের একাংশ জানাচ্ছেন, করোনা অলিখিত ভাবে দারিদ্রের এই পরিধিকেই আরও বিস্তৃত করেছে। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর পপুলেশন সায়েন্সেস-এর ‘ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ়’ বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর অপরাজিতা চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, দেশের কর্মরত জনসংখ্যার (৪৭ কোটি ৪১ লক্ষ) এক চতুর্থাংশ, অর্থাৎ ১১ কোটি ৮৫ লক্ষ মানুষের হাতে কাজ থাকে বছরে ছ’মাসেরও কম। ফলে তাঁদের রুটিরুজির ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতার অভাব এমনিতেই রয়েছে। বাকি প্রায় সাড়ে ৩৫ কোটি মানুষের জীবিকার ক্ষেত্রেও চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে করোনা। অপরাজিতার কথায়, ‘‘করোনা পরিস্থিতিতে ভিক্ষাবৃত্তির হার বৃদ্ধি নিশ্চিত। সঙ্গে আত্মহত্যা, মানসিক অবসাদও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। কারণ, সবাই তো অন্যের কাছে সাহায্য চাইতে পারছেন না বা পারেন না। অন্যের থেকে সাহায্য চাইতে তাঁদের আত্মসম্মানে বাধে।’’

অর্থনীতিবিদদের একটি অংশের বক্তব্য, দারিদ্রসীমা দিয়ে এই মুহূর্তের বিপন্নতা বোঝানো সম্ভব নয়। যেমন এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্কের ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, এ দেশের কর্মরত জনসংখ্যার ১০.৭ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ৫ কোটি ৭২ লক্ষ মানুষ দৈনিক ১৪৪.৫৫ টাকার (দৈনিক ১.৯০ ডলারের কম) কম আয় করেন। অথচ খাতায়-কলমে দারিদ্রসীমার অন্তর্ভুক্ত নয়, বাস্তবে নামমাত্র আয়ের এক বৃহত্তর শ্রেণি রয়েছে। যাঁরা এত দিন নিজের শ্রমের বিনিময়ে পরিবার চালাতেন। করোনা সেই শ্রম-মর্যাদাকেই আঘাত করেছে।

অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকারের মতে, বর্তমান রেশন ব্যবস্থার কারণে খাদ্য সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়েছে। কিন্তু তাঁর কথায়, ‘‘দারিদ্রসীমার উপরেও হাজারটা স্তর রয়েছে। যেমন, নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষেরা তো রাস্তায় বসে ভিক্ষা চাইতে পারবেন না। তাঁরা কী করবেন? এখন তাঁদের অবস্থা নিঃসন্দেহে খুবই খারাপ।’’

আসলে যাপনই তো শুধু নয়, জীবনকেও সরাসরি বিপন্ন করেছে করোনা। যেখানে পাল্টে গিয়েছে জীবনের সংজ্ঞাটাই!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement