দ্রৌপদী মুর্মুকে অভিন্দন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। ছবি: প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সৌজন্যে
এ ভাবেও ফিরে আসা যায়! বছর পাঁচেকের ভিতরে স্বামী-সন্তান-সহ পাঁচ জন কাছের মানুষকে হারিয়েছিলেন। শোকে জর্জরিত সেই মানুষটিকে আর বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব কি না, আলোচনা শুরু করেছিলেন স্বজনেরা। ব্যক্তিগত জীবনের বিষাদময় অধ্যায় কাটিয়ে ফের সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে শামিল করেছেন। তখনও কেউ ভাবতে পারেনি এক দিন তিনিই স্বাধীন ভারতে প্রথম জনজাতি মহিলা হিসাবে রাইসিনা হিলসে পা রাখবেন। হয়ে উঠবেন দেশের প্রথম নাগরিক। দ্রৌপদীর জীবনের ঘটনা যেন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় গল্প-উপন্যাসকেও!
জনজাতি সমাজের এই নেত্রী ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার রাইরঙ্গপুরের বাসিন্দা। আমেরিকায় বারাক ওবামার পিছনে আফ্রো-আমেরিকানদের যেমন প্রবল সমর্থন ছিল, তেমন ভাবেই দ্রৌপদীকে বিপুল সমর্থন জানিয়েছেন এ দেশের জনজাতিরা। প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দা তাঁদের অনেকেই হয়তো এখনও রাইসিনা হিলসের নামই শোনেননি। কিন্তু দ্রৌপদীর এই উত্থানে যেন নিজেদেরই প্রতিষ্ঠা পাওয়ার গর্ব অনুভব করছে জনজাতি সমাজ।
১৯৫৮ সালে এক সাঁওতাল পরিবারে জন্ম দ্রৌপদীর। ঠাকুরমা দ্রৌপদীর নামানুসারেই নাতনিরও ওই নাম। বাবা ও দাদু ছিলেন পঞ্চায়েত প্রধান। গ্রামেই পড়াশোনা শুরু। প্রাথমিক স্কুলে বরাবর পড়াশোনা এবং খেলাধুলোয় প্রথম হতেন। প্রথা ছিল, ক্লাসে যে প্রথম হবে তাকে ‘মনিটর’ করা হবে। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একটি মেয়েকে মনিটর হিসাবে প্রথমে মেনে নেওয়া হয়নি। এক পারিবারিক বন্ধু জানান, ওই অল্প বয়সেই লড়াই করে নিজের অধিকার ছিনিয়ে নেয় ছোট্ট দ্রৌপদী। এর পরে গ্রামের প্রথম মহিলা হিসাবে ভুবনেশ্বরে পাড়ি দেন স্নাতক স্তরে পড়াশোনার জন্য। সেখানে রামদেবী উইমেন্স কলেজে কলা বিভাগে স্নাতক হন। চাকরি পান ওড়িশা সরকারের সেচ ও বিদ্যুৎ বিভাগে জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে। পরে রাইরঙ্গপুরের শ্রী অরবিন্দ ইন্টিগ্রাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতাও করেছেন।
দ্রৌপদীর রাজনৈতিক জীবন শুরু রাইরঙ্গপুরে বিজেপি নেত্রী হিসাবে। ১৯৯৭ সালে রায়রাংপুর নগর পঞ্চায়েতের নির্বাচনে জিতে ভোট রাজনীতিতে হাতেখড়ি। সেখান থেকে মাত্র কয়েক বছরেই চমকপ্রদ উত্থান! ২০০০ সালে রায়রাংপুর নগর পঞ্চায়েতের চেয়ারপার্সন। ওই বছরেই রাইরঙ্গপুর বিধানসভা থেকে জিতে ২০০০-০৪ সালে ওড়িশায় বিজেডি-বিজেপি জোট সরকারে মন্ত্রী হন দ্রৌপদী। পরিবহণ, বাণিজ্য, মৎস্য এবং পশুপালন দফতরের প্রতিমন্ত্রী থেকেছেন। বিজেপির সর্বভারতীয় জনজাতি মোর্চার সহ-সভাপতির দায়িত্বও সামলেছেন। ২০০৭ সালে সেরা বিধায়ক হিসাবে নীলকণ্ঠ পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি।
২০১৫ সালে প্রথম মহিলা হিসাবে ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপালের দায়িত্ব নেন। রাজ্যপাল থাকাকালীনও নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন যথাযোগ্য ভাবে। ২০১৭ সালে দু’টি বিলের সংশোধনী প্রস্তাব ঝাড়খণ্ড বিধানসভায় পাশ হলেও তাতে অনুমোদন দেননি দ্রৌপদী। কারণ, ওই সংশোধনীতে বলা হয়, আদিবাসীরা নিজেদের জমি বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহার করতে পারবেন। এতে আদিবাসীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হতে পারে আঁচ করেই নিজের ক্ষমতার প্রয়োগ করে বিল আটকে দিয়েছিলেন। রাজ্যপালের মেয়াদ শেষ হতে সম্পূর্ণ ভাবে সামাজিক কাজে যুক্ত হয়ে যান। তার কিছু দিনের মধ্যেই ভারতের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব।
দ্রৌপদীর ব্যক্তিগত জীবন চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। কলেজে পড়ার সময়ে শ্যাম চরণ মুর্মুর সঙ্গে পরিচয়। পরে গাঁটছড়া বাঁধেন দু’জনে। তিন সন্তানের জন্ম হয়। দিব্যি চলছিল জীবন। ২০০৯ সালে পরিবারে ঘনিয়ে আসে বিষাদের ছায়া। রহস্যময় মৃত্যু হয় ছেলে লক্ষ্মণের। চরম অবসাদে চলে যান মা। এর পরেই এক আশ্রমে ‘সহজ রাজযোগ’-এর মাধ্যমে বদলে ফেলেন জীবনযাপন। সেই সময় থেকেই ভোর সাড়ে ৩টে ঘুম থেকে উঠে পড়ার অভ্যাস। আবার ঘুমোতে যাওয়া রাত সাড়ে ৯টায়। আধ্যাত্মিকতার মোড়কে যখন সন্তানশোকের ক্ষত কিছুটা প্রশমিত হয়েছে, তখনই বছর চারেক বাদে ফের ধাক্কা! ছোট ছেলে শিপুনের মৃত্যু হয় পথ দুর্ঘটনায়। চোখের জল শুকোনোর আগেই মাসখানেকের মধ্যে মা ও ছোট ভাইয়েরও মৃত্যু হয়। তখনও থামেনি ঝড়। পরের বছরেই দীর্ঘদিনের সঙ্গী স্বামীকেও হারান দ্রৌপদী। পরিবারের পাঁচ সদস্যকে হারিয়ে আধ্যাত্মিক পথ বেছে নেন। হয়ে ওঠেন নিরামিশাষীও। তিনি ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল থাকাকালীন (২০১৫-২১) রান্নাঘরেও আমিষ ঢুকত না।
বর্তমানে দ্রৌপদীর পরিবারের সদস্য বলতে একমাত্র মেয়ে ইতিশ্রী ও তাঁর স্বামী। ইতিশ্রী ওড়িশায় একটি ব্যাঙ্কে চাকরি করেন। ইতিমধ্যেই জনস্বার্থে পাহাড়পুরের জমি দান করেছেন দ্রৌপদী। স্বামী ও সন্তানদের স্মৃতিতে শুরু করেছেন একটি স্কুল। সেখানে আদিবাসী ছেলেমেয়েদের বিনামূল্যে শিক্ষাদান করা হয়। বিষাদকে হারিয়ে এ ভাবেই নতুন পথ বেছে নিয়েছিলেন দ্রৌপদী মুর্মু। সেই পথই গিয়ে মিশল রাষ্ট্রপতি ভবনে।