Indian Institute of Technology

পড়ুয়াদের ‘কবরস্থান’ আইআইটি, খোলা চিঠিতে ক্ষোভ

দেশের নামজাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে আত্মহত্যার ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক। যার সর্বশেষ নজির দিল্লি আইআইটি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২৩ ০৮:৫১
Share:

দিল্লি আইআইটি। ছবি: সংগৃহীত।

‘আই কুইট’— হস্টেলের ঘরের দেওয়ালে কালো কালিতে লেখা ছিল শব্দ দু’টি। সিলিংয়ের পাখায় পেঁচানো ফাঁসে ঝুলছিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া জয় লোবোর মৃতদেহ। প্রশ্ন উঠেছিল, আত্মহত্যা নাকি ‘খুন’? শ্বাসনালিতে চাপের ফলে মৃত্যু, নাকি বছরের পর বছর মাথার মধ্যে জমতে থাকা অস্বাভাবিক চাপ! ২০০৯ সালের ‘থ্রি ইডিয়টস’ ফিল্মের সেই দৃশ্য দেখে শিউরে উঠেছিল কত মন। বুকে হাত রেখে অনেকেই বলেছিলেন, ‘আল ইজ় ওয়েল’। কিন্তু সত্যিই কি সব কিছু ঠিক আছে! দেশের নামজাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে আত্মহত্যার ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক। যার সর্বশেষ নজির দিল্লি আইআইটি। সম্প্রতি প্রথম সারির এই প্রতিষ্ঠানে অঙ্ক বিভাগের, বিটেক চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আয়ুষ আসনা আত্মঘাতী হন। জানা গিয়েছে, স্নাতক হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নম্বর পাননি দলিত এই ছাত্রটি। সেটাই কি কারণ?

Advertisement

আয়ুষের ঘটনার পরে তাঁরই প্রতিষ্ঠানের এক (অজ্ঞাতপরিচয়) পড়ুয়া একটি খোলা চিঠি লিখেছেন, যা চাঞ্চল্য ফেলে দিয়েছে গোটা দেশে। তিনি লিখেছেন, ‘প্রায় প্রতি মাসে আইআইটিগুলোতে পডুয়ার আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। আইআইটি কবরস্থান হয়ে গিয়েছে।’’ তাঁর অভিযোগ, র্যাঙ্ক, গ্রেড, ধর্ম, জাত, ইংরাজি বলতে না-পারা, পরিবারের আর্থিক অবস্থা-সহ অসংখ্য প্রতিযোগিতায় প্রতি দিন নিজেদের ‘যোগ্য’ প্রমাণ করতে হয় পড়ুয়াদের। যাঁরা পারেন না, তাঁরা মাঝপথেই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে দেন, নয় তো ছেড়ে দেন জীবনটাই। ২০ বছরের আয়ুষ হয়তো দ্বিতীয় পথটিই ‘সহজ’ মনে করেছিলেন। খোলা চিঠিতে লেখা হয়েছে, সহপাঠীর মৃত্যুর ছাপ পড়েনি ক্লাসরুমে। আইআইটি কর্তৃপক্ষও একপ্রকার ‘উদাসীন’। অভিযোগ, ছাত্র-মৃত্যুর ঘটনায় ‘আত্মহত্যা’ শব্দটি পর্যন্ত উল্লেখ করেননি আইআইটি কর্তৃপক্ষ। শুধু কয়েকটি শব্দ বলা হয়েছে। যেমন, ‘‘ছাত্রটি খুবই চাপা স্বভাবের ছিলেন... কারও কাছ সাহায্য চাইতে এগিয়ে যাননি... দুর্ভাগ্যজনক।’’

ওই চিঠিতে এ-ও লেখা হয়েছে, ‘আয়ুষ আসনার স্মরণসভায় এমন কোনও পড়ুয়া বা শিক্ষক-শিক্ষিকা উপস্থিত ছিলেন না, যিনি ওঁকে ব্যক্তিগত ভাবে চিনতেন বা ওঁর এন্ট্রি নাম্বার ছাড়া আরও কিছু ওঁর সম্পর্কে জানতেন। এই স্মরণসভা আসলে সবটা ধামাচাপা দিয়ে দেওয়ার একটা প্রক্রিয়া ছিল।’ বিবৃতিতে জানতে চাওয়া হয়েছে, ‘কেন পাঁচটি কোর্সে ফেল করেছিলেন আয়ুষ? ওই কোর্সগুলির কোনও শিক্ষক আয়ুষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন?’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির তরফে শুধু একটিই শব্দ বলা হয়েছে— আয়ুষ খুবই ‘অন্তর্মুখী’ স্বভাবের ছিলেন।

Advertisement

দিল্লি আইআইটি-র এক পড়ুয়ার (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) অভিজ্ঞতায়, প্রতিষ্ঠানের ভিতরে জাত বা ধর্মের বাধা তিনি অনুভব করেননি। তাঁর কাছে, মূল সমস্যা হল অধ্যাপকদের উদাসীনতা। সাহায্য করার বদলে ছাত্রদের ‘বিপন্ন’ করার মানসিকতা। যেন ‘থ্রি ইডিয়টস’-এর ডায়লগ হুবহু তুলে ধরে তিনি বলেন, তাঁর বন্ধুকে শুনতে হয়েছিল, ‘‘তোমায় পাশ করাবো না। চাকরি কী করে পাও দেখব!’’

দিল্লি আইআইটি-র এক জনজাতিভুক্ত পড়ুয়ার বক্তব্য, দলিত হওয়ার জন্য কাউকে হেনস্থা হতে হয় না। তাঁর কথায়, ‘‘ আমাদের অনেকে র্যাঙ্কিংয়ে পিছনে থাকলেও আসন সংরক্ষণের জন্য আইআইটি-র মতো প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পেয়ে যায়। কিন্তু এর পরে সাধারণ বিভাগের পড়ুয়াদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পারে না। নম্বর কম আসে। চাকরি হয় না। সেখান থেকে হতাশা।’’ তাঁর কথায়, ‘‘সংরক্ষিত আসনে ভর্তি হওয়া এমন পড়ুয়ার সংখ্যা খুবই কম, যাকে এই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি।’’

আইআইটিতে সুযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পড়ুয়াদের কাঁধে চলে আসে প্রত্যাশার বোঝা। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠান থেকে কি ১০০ শতাংশ পড়ুয়া চাকরি পান? একাংশের উত্তর না। কিন্তু যাঁরা পান না, তাঁদের খবর কেউ জানতে পারে না। প্রতিষ্ঠানের বাইরেও না, ভিতরেও না। এ কথা জানিয়েছেন আইআইটি-র এক পড়ুয়া। তাঁর মা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘প্রতিষ্ঠানের ভিতরে অনেক কিছুই ফোঁপরা। এক বিশাল অডিটোরিয়ামে ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে শুধু অবস্থানগত নয়, মানসিক ব্যবধানও অনেক বেশি। পড়াশোনার বিপুল বোঝা ও কেরিয়ারের ইঁদুর দৌড়ে কোথাও হয়তো চারপাশের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পড়ুয়ারা।’’ পড়ুয়াদের মানসিক স্বাস্থ্য দেখার জন্য একটি বিভাগ রয়েছে। তবে অনেক ছাত্রেরই অভিজ্ঞতা, সেখানে শুনতে হয়, ‘‘আজ হবে না। সামনের সপ্তাহে আসুন।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement