অনাহার, গার্হস্থ্য হিংসা, ছোট বোনের মৃত্যুর বিচার— ছোটবেলাটা এ সব নিয়েই টালমাটালে কেটেছিল তাঁর। পরিবারে অভাব এতটাই ছিল যে, অষ্টম শ্রেণির পর আর পড়াশোনা চালাতে পারেননি। এগুলো পেরিয়ে যখন মাথা তুলে একটু শ্বাস নিচ্ছিলেন, ফের আর এক অভিশাপ নেমে এল তাঁর জীবনে।
মারণ রোগ শক্ত কামড় বসিয়ে দিল তাঁর জীবনে। কিন্তু সেটাও নড়াতে পারেনি তাঁকে। নিজের কথা না ভেবে বস্তির শিশুদের মুখে খাবার তুলে চলেছেন তিনি। ওই শিশুগুলোর ‘সুপারহিরো’ আঁচল।
দিল্লির রংপুরীর একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে আঁচল শর্মার জন্ম। বাবা-মা আর তিন ভাইবোন তাঁরা। বাবা ছিলেন একজন অটোচালক। অন্যের কথায় প্রভাবিত হয়ে উপার্জনের সমস্ত টাকা একটি গাড়ি কিনতে খরচ করে ফেলেন। কিন্তু গাড়ির ব্যবসায় লাভের মুখ দেখেননি তিনি। এ দিকে অটো চালানোর কাজটাও চলে যায়।
হতাশ হয়ে মদের নেশায় বুঁদ হয়ে যান তিনি। দারিদ্র থাকলেও সংসারে শান্তি ছিল। বাবার কাজ হারানোর পর থেকে সেই শান্তিটুকুও নষ্ট হয়ে যায়। রোজ মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরে আঁচলের মাকে বেধড়ক মারধর করতেন তিনি।
তিন সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে বাধ্য হয়েই একটি কারখানায় শ্রমিকের কাজ নেন আঁচলের মা। সারা দিন পরিশ্রমের পর সামান্য বেশি রোজগারের জন্য দিনের পর দিন অতিরিক্ত সময়েও কাজ করেছেন। কিন্তু সে কাজও বেশি দিন টেকেনি।
বাড়িতে খাবার থাকত না সে সময়। দিনের পর দিন অনাহারেই কাটিয়েছেন আঁচলরা। কখনও কখনও একটি বা দুটো রুটি লঙ্কা গুঁড়ো দিয়ে রোল করে খেয়ে নিতে হয়েছিল তাঁদের। সেটাই তখন তাঁদের কাছে এলাহি খাবার।
আঁচল তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়েন আর তাঁর দাদা নবম শ্রেণিতে। মাইনে দিতে না পেরে দু’জনকেই স্কুল ছাড়তে হয়। দাদা কাছের একটি মোটর গ্যারেজে কাজ শুরু করেন। আঁচলও একটি সংস্থার রিসেপশনিস্টের কাজ পান। অনেকটা উন্নতি হয় পারিবারিক পরিস্থিতির।
সে সময় প্রতি মাসে ৪০০০ টাকা মাইনে পেতেন তিনি। পড়াশোনা না জানা তাঁর কেরিয়ারে বাধা হতে পারেনি। দ্রুত সব কিছু শিখে নিয়েছিলেন তিনি।
এমনকি ইংরাজি বলাটাও খুব সুন্দর রপ্ত করে নিয়েছিলেন। নিজের চেষ্টায় ক্রমে কেরিয়ারের গ্রাফ উপরে তুলেছেন। প্রমোশান পেয়েছেন, এমনকি একটি ফ্ল্যাটও কিনেছেন নিজের উপার্জনে। অত্যন্ত লড়াকু এই মেয়েটা কখনও নিজের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে বিলাপ করেননি।
তাঁর বোন একটি ছেলেকে ভালবেসেছিলেন, কিন্তু বাবা-মা কিছুতেই তা মানতে চাইছিলেন না। আঁচলই মধ্যস্থতা করে, খরচ করে বিয়ে দেন বোনের। দিনগুলো খুব আনন্দেই কাটছিল তাঁর।
কিন্তু বিয়ের পাঁচ মাসের মধ্যে বোনের মৃত্যু হয়। অভিযোগ, তাঁর স্বামীই তাঁকে খুন করেন। এতদিন যে শক্তি নিয়ে সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছিলেন, সেই আঁচল কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না বোনের মৃত্যু। বিধ্বস্ত মন নিয়েও বিচারের জন্য লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন।
বিয়েটা আঁচলেরও ভাল হয়নি। বাবা-মা একপ্রকার জোর করেই বিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর। কিন্তু পর দিন থেকেই মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন তিনি। তিন মাসের মধ্যে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে আসেন। এটাই শেষ নয়, জীবনের প্রতিটা মোড়ে আঁচলকে হোঁচট খেতে হয়েছে, প্রতিটা মোড়ে তাঁকে আরও বেশি মনের জোর নিয়ে লড়ে যেতে হয়েছে।
এর পর যেমন তাঁর জন্য তৈরি ছিল আরও দুটো খাঁড়া। প্রায় একই সঙ্গে বাবা-মা দু’জনেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাবার যক্ষ্মা হল আর মা খুব বিরল স্নায়ু রোগে আক্রান্ত হলেন। আঁচল একাই দু’জনের চিকিৎসার ভার নিয়ে নিলেন। অর্থের জন্য কেরিয়ারে আরও বেশি নজর দিলেন। এ সব করতে গিয়ে যেটা হল, নিজের প্রতিই যত্ন নিতে ভুলে গেলেন।
খেয়ালই করলেন না যে তাঁর স্তনে একটি লাম্প হয়েছে। যন্ত্রণা, ব্যথায় যখন আর উপেক্ষা করা সম্ভব হল না, তত দিনে থার্ড স্টেজ ব্রেস্ট ক্যানসারে পরিণত হয়ে গিয়েছে সেই ছোট লাম্পটি। ২০১৭ সালে ক্যানসার চিকিৎসা শুরু হয় আঁচলের। জীবন সম্পূর্ণ অন্যদিকে মোড় নিয়ে নেয় সে দিন থেকেই।
একদিন চিকিৎসকের কাছ থেকেই ফিরছিলেন আঁচল। ট্রাফিক সিগন্যালে কতগুলো শিশু তাঁর কাছে টাকা চায়। আঁচল তাঁদের খাওয়ানোর জন্য পাশের একটি রেস্তোরাঁয় নিয়ে যান। দোকানদার তাদের খাবার দেবেন না, স্পষ্ট জানিয়ে দেন।
পাশের অন্য একটি দোকানে যান তাঁরা। ছেঁড়া, নোংরা জামা পরা বাচ্চাগুলোকে দেখে অন্যেরা দোকান ছেড়ে চলে যান। ক্রেতা চলে যাচ্ছে দেখে, সেই দোকানদারও তাদের খাবার দেননি আর।
সে দিন থেকেই আঁচল স্থির করেন, তাদের খাওয়ানোর দায়িত্ব নেবেন। তাদের জন্য রান্না করে খাবার নিয়ে যেতে শুরু করেন তিনি। প্রথমে ৫-৬ জন বাচ্চাকে খাওয়াতেন, এখন সেই সংখ্যাটা প্রায় ২০০। আশেপাশের লোকেদের থেকে কিছু সাহায্যও পান তিনি। ‘মিলস ফর হ্যাপিনেস’ নামে নিজের একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা খুলেছেন। তাঁর স্বপ্ন এমন ৫০০০ শিশুর মুখে রোজ খাবার পৌঁছে দেওয়া।
ক্যানসার হয়েছে জানলেই মানুষ আর্থিক এবং মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন। সেখানে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হয়েও যে ভাবে মনে জোরে বস্তির বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন তিনি, সে জন্য কখনও হার না মানা আঁচলকে কুর্নিশ জানিয়েছেন তাঁর চিকিৎসকেরাও। যে হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলছে, সেখান থেকে তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছে।
কোনও কাল্পনিক ক্ষমতা নেই তাঁর, জাদু ছড়ি ঘুরিয়ে বা তুড়ি মেরে খাবার হাজির করতে পারেন না। ছোটদের কল্পনার মতো আকাশে উঠে পাক খেতেও পারেন না, কিন্তু ওই শিশুগুলোর কাছে তিনিই ‘সুপারহিরো’। রিয়েল লাইফ সুপারহিরো।