‘বম্বে ন্যাচরাল হিস্ট্রি সোসাইটি’-র সদস্য ছিলেন শ্রীধর রঙ্গনাথন। কাজের টানে প্রায়ই যেতে হত দুর্গম পাহাড়ের বনে জঙ্গলে। সে সব অভিযানে সঙ্গী হত তাঁর একমাত্র মেয়ে, ঐশ্বর্যা। সে দিনের শিশু এখন ২৩ বছর বয়সি তরুণী। বাবার মতোই ছকভাঙা জীবন বেছে নিয়েছেন তিনি। দেশের প্রথম সারির ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফারদের মধ্যে অন্যতম ঐশ্বর্যা শ্রীধর। সম্প্রতি ভূষিত হয়েছেন আন্তর্জাতিক সম্মানে।
ঐশ্বর্যার পরিবার আদতে তামিল। দীর্ঘ দিন ধরে তাঁরা মুম্বইবাসী। সেখানেই ১৯৯৭-এর ১২ জানুয়ারি জন্ম ঐশ্বর্যার। ডক্টর পিল্লাই গ্লোবাল অ্যাকাডেমির প্রাক্তনী ঐশ্বর্যা বরাবরই মেধাবী।
২০১৩ সালে কেমব্রিজ ইন্টারন্যাশনাল পরীক্ষায় বিজনেস স্টাডিজ পেপারে তিনি সারা বিশ্বের পডুয়াদের মধ্যে ছিলেন মেধা তালিকার শীর্ষে। পরে মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস মিডিয়ায় স্নাতক হন।
পড়াশোনার পাশাপাশি ক্যামেরায় হাতেখড়ি ১৩ বছর বয়সে। বাবার সঙ্গে মহারাষ্ট্রের রত্নগিরিতে পশ্চিমঘাট পর্বতের জঙ্গলে যেতেন ট্রেকিংয়ে। যত দিন এগিয়েছে, লেন্স আর বন্যজীবন, দুটোকেই আরও বেশি করে জড়িয়ে ধরেছেন ঐশ্বর্যা।
২০১৮ সালে ঐশ্বর্যার তৈরি তথ্যচিত্র ‘পঞ্জে—দ্য লাস্ট ওয়েটল্যান্ড’ দেখানো হয়েছিল দূরদর্শনে। জলাভূমি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এই তথ্যচিত্র ছিল প্রতিবাদের অন্যতম হাতিয়ার।
সুন্দরবনের বাঘিনি মায়াকে নিয়ে ঐশ্বর্যার তথ্যচিত্র ‘দ্য কুইন অব তরু’ পুরস্কৃত হয়েছিল বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ চলচ্চিত্র উৎসব-এও। মহারাষ্ট্রের তাড়োবা অভয়ারণ্যে ৬ বছর ধরে মায়াকে লেন্সবন্দি করেছেন ঐশ্বর্যা। সেই ছবি ও ভিডিয়ো সম্পাদনা করেই তৈরি হয়েছে এই তথ্যচিত্র।
তবে অতীতের সব কৃতিত্বকে ছাপিয়ে গিয়েছে সাম্প্রতিক পুরস্কার। ঐশ্বর্যা পেয়েছেন ‘ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফার অব দ্য ইয়ার ২০২০’ সম্মান। ইংল্যান্ডের ন্যাচরাল হিস্ট্রি মিউজিয়ম আয়োজিত এই প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষিত হয়েছে চলতি মাসেই।
পৃথিবীর ৮০টি দেশের আলোকচিত্রীদের মোট ৫০ হাজার ছবির মধ্যে বেছে নেওয়া হয়েছে ১০০টি ছবি। তার মধ্যে আছে ঐশ্বর্যার তোলা ছবিটিও। প্রথম মহিলা ভারতীয় আলোকচিত্রী এবং কনিষ্ঠতম প্রতিযোগিনী হিসেবে এই সম্মান পেলেন তিনি।
কী ছিল ঐশ্বর্যার লেন্সবন্দি ছবিতে? ছিল রাতের অন্ধকারে জঙ্গল ঘিরে জোনাকিদের ছায়াপথ। কিংবা জোনাকিদের নক্ষত্রপুঞ্জও বলা যায়। জোনাকিদের আলো সেভাবেই ধরা পড়েছিল ঐশ্বর্যার লেন্সে। সেই মায়াময় আরণ্যক সৌন্দর্যভরা ছবির নাম তিনি দিয়েছেন ‘লাইটস অব প্যাশন।’
সংবাদপত্রে ঐশ্বর্যা পড়েছিলেন পশ্চিমঘাট জঙ্গলে বর্ষায় জোনাকিদের মেলা বসে। সেই ছবি তুলতে পানভেলে নিজের বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলেন ভান্ডারডারা। তার পর স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে রাতের অন্ধকারে আড়াই ঘণ্টা হেঁটে পৌঁছেছিলেন সহ্যাদ্রির ঢালে ঘন বনে।
পথে নিশাচর বন্য প্রাণীর সঙ্গে সাক্ষাৎ থেকে গাছের শিকড়ে পা বেঁধে হোঁচট খাওয়া— ছিল সব অভিজ্ঞতাই। কিন্তু সব কষ্ট ম্লান হয়ে গিয়েছিল জোনাকিদের লক্ষ আলোর সৌন্দর্যে। প্রথম বারের ছবিতে মন ভরেনি। দ্বিতীয় বার আকাশের তারা আর বনের জোনাকিদের ধরেছিলেন একই ফ্রেমে। সেই ছবিই বাজিমাত করল আন্তর্জাতিক মহলে।
প্রতিযোগিতায় ‘ইনভার্টিব্রেট বিহেভিয়ার’ বিভাগে স্থান পেয়েছে ঐশ্বর্যার ছবি। জল, স্থল বা আকাশে অমেরুদণ্ডী ছোট প্রাণীদের ‘অন্যরকম বা অভিনব আচরণ’ হল এই বিভাগের বিষয়।
গত বছর জুন মাসে জোনাকিদের উড়ানের সেই ছবি কোনও কিছু ভেবে তোলেননি ঐশ্বর্যা। ফ্রেমও করেছিলেন বেশি কিছু হিসেব না করে। বেহিসেবি সেই ভাল লাগাই এনে দিল শ্রেষ্ঠত্বের কুর্নিশ।
ছোটবেলায় ঐশ্বর্যার ইচ্ছে ছিল ফরেস্ট সার্ভিসে যোগ দেওয়া। কিন্তু পরে বুঝলেন অরণ্য আর ছবি একসঙ্গে পাওয়ার জন্য তাঁকে ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফারের জীবনই বেছে নিতে হবে।
গত কয়েক মাস ধরে ঐশ্বর্যা ব্যস্ত ফ্লেমিঙ্গোদের ছবি তুলতে। তাঁর পরবর্তী ইচ্ছে ভারতের বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণ নিয়ে ছবি তৈরি। কাজও শুরু করেছিলেন। কিন্তু থমকে গিয়েছে অতিমারির জন্য। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ফের কাজ শুরু করবেন।
দেশ বিদেশের বহু সম্মানের পালক ইতিমধ্যেই জায়গা করে নিয়েছে ঐশ্বর্যার মুকুটে। সে সব নিয়ে ভাবতে চান না। ভবিষ্যতেও বন্যপ্রাণকে ফ্রেমবন্দি করে যেতে চান আরণ্যক গন্ধ গায়ে মেখে। (ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া)