পটনায় বিজেপি-বিরোধী নেতাদের বৈঠক। ছবি: পিটিআই।
আদর্শগত বিরোধ আছে। কিন্তু কেন্দ্র থেকে বিজেপিকে সরাতে হলে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে ঐক্যবদ্ধ ভাবে লড়াই করতে হবে। শুক্রবার বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের পটনার বাড়িতে ১৫টি বিরোধী দলের বৈঠকের পর বিকেলে সাংবাদিক বৈঠক থেকে এই বার্তাই দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। কিন্তু আগামী মাসে হিমাচল প্রদেশের শিমলায় আরও একটি বৈঠক করবে বিরোধীরা। কিন্তু ১৬টি বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রায় চার ঘণ্টার বৈঠকের পরও খটকা থেকেই গেল। কারণ, বৈঠকের পর যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে দেখা যায়নি আম আদমি পার্টি (আপ) প্রধান তথা দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীওয়াল, তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী তথা ডিএমকে প্রধান এমকে স্টালিনকে। যদিও অনুপস্থিতির কারণ জিজ্ঞাসা করতে নীতীশের দাবি, বিমান ধরার তাড়ায় তাড়াতাড়ি পটনা ছেড়েছেন দুই মুখ্যমন্ত্রী।
তার পরেও অবশ্য ‘কিন্তু’ রয়ে গিয়েছে। দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির যৌথ সাংবাদিক বৈঠক চলাকালীন আপের তরফে জানানো হয়, কংগ্রেস কেন্দ্রের বিতর্কিত অর্ডিন্যান্সের প্রকাশ্যে বিরোধিতা না করা পর্যন্ত ভবিষ্যতে কোনও বিরোধী বৈঠকে তারা অংশ নেবে না। কংগ্রেসের একটি সূত্র জানাচ্ছে, পটনায় বৈঠকে দিল্লিতে আমলাতন্ত্রের দখল নিয়ে কেন্দ্রের বিতর্কিত অর্ডিন্যান্সের প্রসঙ্গ তুলে ক্ষোভ উগরে দেন কেজরীওয়াল। তিনি নাকি স্পষ্ট জানতে চান, মোদী সরকার ওই অর্ডিন্যান্সকে আইন করতে লোকসভায় বিল আনলে কংগ্রেস তা সমর্থন করবে কি না। এমনকি, এ নিয়ে কংগ্রেস এবং আপ নেতৃত্বের এক দফা তর্কাতর্কিও হয় বৈঠকে। সংশ্লিষ্ট অর্ডিন্যান্স নিয়ে কংগ্রেসের অবস্থান জানতে চান আপ প্রধান। সে সময় কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গেও বেশ কিছু কথা বলেন। সাংবাদিক বৈঠকে খড়্গে বলেছেন, বিরোধী দলগুলো আবার ১০ থেকে ১২ জুলাই বৈঠকে বসবে। সেখানে লোকসভা ভোটকে সামনে রেখে রাজ্যভিত্তিক পর্যালোচনা করবেন তাঁরা। রাহুল গান্ধী বলেন, ‘‘এটা মতাদর্শের লড়াই। আমাদের (বিরোধী দলগুলোর) মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে বিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু এই লড়াই লড়তে হলে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতেই হবে।’’ কিন্তু সমস্ত বিরোধী দল কি একছাতার নীচে আসবে? যখন আলোচনার শুরুতেই কেজরীওয়াল বা স্টালিনের অনুপস্থিতি নিয়ে বিরোধী জোটের তাল কাটার প্রশ্ন উঠছে। রাহুল বলছেন, এটা চটজলদি হবে না। তাঁর কথায়, ‘‘এটা একটা প্রক্রিয়া এবং তাকে এক যোগে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’’ রাহুলের সুর শোনা গিয়েছে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতার গলাতেও। সাংবাদিক বৈঠকে তিনি বলেন, ‘‘তিনটি বিষয়ের সমাধান করা হয়েছে (বৈঠকে)। এক, আমরা ঐক্যবদ্ধ, আমরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে লড়াই করব। দুই, আমাদের লড়াইকে বিরোধীদের লড়াই হিসাবে চিহ্নিত না করে বিজেপির স্বৈরাচার শাসন এবং কালো আইনের বিরুদ্ধে লড়াই মনে করতে হবে। এবং তিন, ওদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই করা উচিত।’’ এক মঞ্চে ছিলেন পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি এবং ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ওমর আবদুল্লাও। মুফতি বলেন, ‘‘যে ভাবে দেশের মানুষ বিশেষত, সংখ্যালঘুদের সঙ্গে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে গান্ধীজির ভারত নয় গডসের ভারত হয়ে যাবে।’’ আর ওমরের দাবি, কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত ১৭টি রাজনৈতিক দল ক্ষমতার জন্য নয়, মতাদর্শের জন্য একজোট হয়েছে।
মমতা-রাহুলের যৌথ অঙ্গীকার
বিরোধীদের যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি তথা প্রাক্তন সাংসদ রাহুল বলেন, বিজেপি ভারতীয় সংস্কৃতির শিরদাঁড়ায় আঘাত করছে। যে নীতি এবং আদর্শের উপর ভিত্তি করে ভারত তৈরি হয়েছিল, তার উপরেই আঘাত করছে।
তৃণমূলের একাংশের দাবি, রাহুলের ‘নমনীয়’ হওয়ার বক্তব্য লোকসভা নির্বাচনে মমতার ‘তত্ত্ব’ (যে দল যেখানে শক্তিশালী, তাকে সেখানে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ার সুযোগ দিতে হবে। অর্থাৎ, বাংলায় আসনরফা বা সমঝোতা বা জোটের ক্ষেত্রে তৃণমূলই শেষ কথা বলবে)-এর দিকে ইঙ্গিত করছে। অনেকে এ-ও বলছেন, রাহুল ‘নমনীয়’ হওয়ার কথা বলে মমতাকে বার্তা দিলেন। যদিও কংগ্রেস মনে করছে, রাহুল আদতে মমতাকেই নমনীয় হওয়ার বার্তা দিয়েছেন। ঘটনাক্রমে রাহুলের পরেই ওই সাংবাদিক বৈঠকে বলেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘আমরা একজোট। আমরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে লড়াই করব। ওরা (বিজেপি) মনে করে, ইতিহাস বদলে দিতে হবে! আমরা বলতে চাই, বিহার থেকেই শুরু হবে ইতিহাসরক্ষার লড়াই।’
পটনায় নতুন সমীকরণ
পটনায় বিজেপি বিরোধী বৈঠকে তৃণমূল নেত্রী মমতা ছাড়াও ছিলেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছিলেন রাহুল ও খড়্গে, কেজরীওয়াল, জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা পিডিপি সভানেত্রী মেহবুবা মুফতি, জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ওমর আবদুল্লা, ডিএমকে প্রধান তথা তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিনের মতো বিরোধী নেতারাও। তাঁরা ছাড়া বৈঠকে ছিলেন এনসিপি প্রধান শরদ পওয়ার ও তাঁর কন্যা সুপ্রিয়া সুলে, জেএমএম প্রধান তথা ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন, সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি, সিপিআই সাধারণ সম্পাদক ডি রাজা, সিপিআইএমএল (লিবাবেশন)-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা শিবসেনা (বালাসাহেব) প্রধান উদ্ধব ঠাকরে এবং উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা সমাজবাদী পার্টির সভাপতি অখিলেশ যাদবের মতো নেতারা। আরজেডি প্রধান লালুপ্রসাদ এবং তাঁর পুত্র তথা বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী তেজস্বী যাদবকেও বিরোধী নেতাদের বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা গিয়েছে। রাজ্যে যুযুধান প্রতিদ্বন্দ্বী কিন্তু এখন তারা বিজেপি বিরোধী, এমন একাধিক দলের নেতাকে দেখা গেল একান্তে কথাবার্তা বলতে। যেমন, ওমর আবদুল্লা এবং মেহেবুবা মুফতি। যেমন, উদ্ধব ঠাকরে এবং শরদ পাওয়ার। এমনকি, রাহুলের সঙ্গে মমতাও কথা বলেছেন। আবার অটল বিহারী বাজপেয়ীর জমানায় রেলমন্ত্রকের ‘দখল’ নিয়ে যে মমতা এবং নীতীশের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, তাঁর সঙ্গে বসে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের শপথ নেওয়ার ছবিও দেখা গেল। শুক্রবার যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে বিরোধী দলগুলির শীর্ষ নেতা-নেত্রীদের সম্বোধন করতে গিয়ে রাজার পাশাপাশি সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিরও নাম করেছেন মমতা! ঘটনাচক্রে, যে ইয়েচুরির দলের বিরুদ্ধে আপোসহীন লড়াই থেকেই তাঁর রাজনৈতিক উত্থান। যে ইয়েচুরির দলের ৩৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে তাঁর বাংলার ক্ষমতা দখল। যে ইয়েচুরির দলের বাংলার কমরেড মহম্মদ সেলিম শুক্রবারও পঞ্চায়েত ভোটে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলেছেন তৃণমূলের বিরুদ্ধে। এমনই একাধিক টুকরো টুকরো ছবি দেখা গেল পটনায়। যা থেকে বিরোধীদের নতুন সমীকরণ দেখছেন অনেকে।
বিরোধী মঞ্চে মমতার তোপে রাজ্যপাল
বিরোধী বৈঠক ছিল কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে হটাতে জোট গঠনের লক্ষ্যে। কিন্তু সেই মঞ্চ থেকে বাংলার রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসকে লক্ষ্য করে রাজনৈতিক আক্রমণ করলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। বিরোধী বৈঠকের পরে যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে তুলে আনলেন ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ পালন আর ‘মর্জিমাফিক উপাচার্য নিয়োগ’ প্রসঙ্গ। মমতা বলেন, ‘‘আমরা পশ্চিমবঙ্গে থেকেও কোনও ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’-এর কথা শুনিনি! উনি তা পালন করে ফেললেন!’’ নাম না করে রাজ্যপাল বোসের বিরুদ্ধে ‘মর্জিমাফিক’ উপাচার্য নিয়োগেরও অভিযোগ তোলেন মুখ্যমন্ত্রী। নাম না করে রাজ্যপাল বোসের বিরুদ্ধে ‘মর্জিমাফিক’ উপাচার্য নিয়োগেরও অভিযোগ তোলেন মুখ্যমন্ত্রী। ‘‘এখন ওরা (বিজেপি) অনেক আইনজীবীকে দিয়ে মামলা করে। আমাদের বিরুদ্ধে সিবিআই নয়তো ইডি তদন্ত শুরু হয়। পঞ্চায়েত ভোট নিয়েও সিবিআই তদন্তের নির্দেশ হয়!’’
হাওড়ার উলুবেড়িয়ায় পঞ্চায়েত ভোটে প্রার্থীর নথি বিকৃতিকাণ্ডে বৃহস্পতিবার সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাই কোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ (শুক্রবার অবশ্য ডিভিশন বেঞ্চ তা স্থগিত করেছে)। সেই প্রসঙ্গে ওই মন্তব্য করেন মমতা। মমতার ওই উষ্মাকে অস্বাভাবিক বলে তৃণমূলের নেতারা মনে করছেন না। তাঁদের মতে, রাজ্যপাল কেন্দ্রীয় সরকারেরই প্রতিনিধি বা প্রতিভূ। ফলে তাঁর কার্যকলাপ কেন্দ্রীয় সরকারের ‘মদতপুষ্ট’ এটা বলাই যেতে পারে। ফলে তাঁকে আক্রমণ আর কেন্দ্রীয় সরকারকে আক্রমণ একই কথা।