প্রণব মুখোপাধ্যায় হয়ে ওঠার পিছনে কারিগর ছিলেন শুভ্রাই

কয়েক দিন আগের কথা। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পুরী গিয়েছিলাম। নবকলেবরে সজ্জিত হওয়ার পরে জগন্নাথ দর্শন করাটাই ছিল প্রণববাবুর বিশেষ ইচ্ছে। জগন্নাথ মন্দিরে পুজো দিয়ে ওঁর সঙ্গে ফিরে এলাম পুরীর রাজভবনে।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০১৫ ১৩:৫২
Share:

শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের ছবি টুইটারের সৌজন্যে।

কয়েক দিন আগের কথা। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পুরী গিয়েছিলাম।

Advertisement

নবকলেবরে সজ্জিত হওয়ার পরে জগন্নাথ দর্শন করাটাই ছিল প্রণববাবুর বিশেষ ইচ্ছে। জগন্নাথ মন্দিরে পুজো দিয়ে ওঁর সঙ্গে ফিরে এলাম পুরীর রাজভবনে। সমুদ্রতটের সেই রাজভবনে ঢোকার পর দিল্লি থেকে খবর এল, রাষ্ট্রপতির স্ত্রী শুভ্রা মুখোপাধ্যায় খুবই অসুস্থ। তাঁকে সেনা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। শুভ্রাদেবী আইসিইউ-তে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। লাইফ-সাপোর্ট সিস্টেমে তাঁকে রাখা হয়েছে। এই খবর শোনার পরেই প্রণববাবু সিদ্ধান্ত নিলেন, আর এক মুহূর্তও তিনি পুরীতে থাকবেন না। দিল্লিতে ফিরে যাবেন। অথচ, পরের দিন ভুবনেশ্বরে রাষ্ট্রপতির ঠাসা কর্মসূচি রয়েছে! আইনি শিক্ষার প্রচার নিয়ে এক জাতীয় সম্মেলনে সেখানে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির আসার কথা। তাঁর সঙ্গে থাকবেন প্রায় ১৫ জন বিশিষ্ট বিচারপতি। ওড়িশার রাজ্যপাল সি জামির এবং মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কও থাকবেন। কিন্তু, কর্মসূচি বদলে গেল। সন্ধে নেমে এসেছে। তাই হেলিকপ্টার উড়ল না। সড়ক পথে পুরী থেকে ভুবনেশ্বর ফিরে এলেন রাষ্ট্রপতি। তার পর বিশেষ বিমানে করে গভীর রাতে দিল্লি পৌঁছলেন। সেখান থেকে স্ত্রীকে দেখতে সোজা হাসপাতালে গেলেন তিনি।

দীর্ঘ কয়েক দশকের সম্পর্ক। ব্রাহ্মণের ঘরের ছেলে প্রণবের সঙ্গে অব্রাহ্মণ শুভ্রার বিবাহ নিয়ে পরিবারের আপত্তি ছিল। রক্ষণশীল পরিবারের ছেলে হয়েও প্রণববাবু প্রথা ভেঙে বিয়ে করেছিলেন শুভ্রাকে। ১৯৬৯-এ তিনি যখন রাজ্যসভায় বাংলা কংগ্রেসের সদস্য হয়ে দিল্লি এলেন, তখন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত শুভ্রাই ছিলেন তাঁর জীবনসঙ্গিনী। ওই বছরেই সাংসদ হিসেবে প্রথম ফ্ল্যাট পেয়েছিলেন প্রণববাবু। বাড়িতে আসবাবপত্র প্রায় নেই বললেই চলে। একটা প্রচণ্ড নিরাভরণ বাড়িতে প্রণববাবু এবং শুভ্রাদেবীর সঙ্গে চায়ের আড্ডাতে বেশ কয়েক ঘণ্টা কাটানোর কথা তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার। শুভ্রাদেবী সেই সময় থেকেই প্রণববাবুর বহির্জগতের সঙ্গে জনসংযোগের দায়িত্ব পালন করতেন। পাশাপাশি, বাড়িতে পর্দা কী রঙের হবে বা কোন আসবাব কোথায় বসানো হবে সেটাও ঠিক করতেন তিনি। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী খুব স্নেহ করতেন শুভ্রাদেবীকে। তাঁর হাতের মাছের ঝোল খেতে মাঝে মাঝে আসতেন ইন্দিরা। শুভ্রার সঙ্গে সরাসরি একটা যোগাযোগ ছিল তাঁর।

Advertisement

দেখুন গ্যালারি:

স্মরণে শুভ্রা

যত দিন গড়িয়েছে, ততই ব্যস্ত হয়েছেন প্রণববাবু। অন্য দিকে, ছেলেমেয়েরা কোথায় পড়বে থেকে নাতি-নাতনিদের ব্যাপারে নজর রাখতেন শুভ্রাদেবী। দিল্লির গ্রেটার কৈলাসে এস ২২ নম্বর বাড়ি যখন তৈরি হল, তখনও কিন্তু তার সমস্ত দেখাশোনা করতেন তিনি নিজেই। এক বার বন্যায় ওই বাড়ির মধ্যে জল ঢুকে যায়। বেসমেন্টে রাখা ছিল প্রণববাবুর অনেক পুরনো অ্যালবাম, ডায়েরি এবং বই। শুভ্রাদেবী নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সেই জল নিকাশির ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু, কয়েক দিন আগেও এই প্রতিবেদককে দুঃখ করে শুভ্রাদেবী বলছিলেন, ‘‘ওই বন্যায় আমাদের কত পুরনো ছবি যে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তোর দাদার কত ডায়েরি যে অপাঠ্য হয়ে গেল, তা কোনও দিন ভুলব না।’’

দাম্পত্য জীবনে সব সময়েই মেঘ-রোদ্দুরের খেলা থাকে। জীবনে অনেক চড়াই-উত্‌রাই আসে। সম্পর্কও নানা রকমের বাঁক নেয়, বহতা নদীর মতো। কিন্তু, একটা সময় আসে যখন স্মৃতিতে জমা হয়ে থাকা সমস্ত পলির মধ্যে থেকে মানুষ সম্পর্কের শক্তি সঞ্চয় করে। প্রণববাবু দু’বার দেশের অর্থমন্ত্রী, দু’বার বাণিজ্যমন্ত্রী এবং দু’বার বিদেশমন্ত্রী হয়েছেন। এই সব সময়ে তিনি প্রচণ্ড ব্যস্ত ছিলেন। আবার শুভ্রাও ব্যস্ত ছিলেন তাঁর সঙ্গীত জীবন নিয়ে। গীতাঞ্জলি নামে তাঁর একটি সঙ্গীতের দল ছিল। দেশ-বিদেশেও সেই দল নিয়ে অনুষ্ঠান করে বেড়াতেন তিনি।

১৩ নম্বর তালকোটরা রোডের বাড়িতে যখন এলেন প্রণববাবুরা, তখন থেকেই অসুস্থ হতে লাগলেন শুভ্রাদেবী। একটা সময় এল, পায়ের স্নায়ুর সমস্যায় আর হাঁটতে পারতেন না তিনি। বিছানায় সারা ক্ষণ শুয়ে থাকতেন। সামনে রাখা থাকত ছোট একটা টেলিভিশন। সিরিয়াল এবং উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখতে খুবই পছন্দ করতেন। বিছানায় বালিশের এক পাশে তারাশংকর আর অন্য পাশে অজস্র ওষুধ। প্রণববাবু যত রাত করেই বাড়ি ফিরুন না কেন, স্ত্রীর ঘরে গিয়ে তাঁর বিছানার পাশে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসতেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। আর এই মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষা করতেন শুভ্রা মুখোপাধ্যায়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement