নেপালি যুবক। — নিজস্ব চিত্র।
বৃষ্টি ভেজা বসন্তের সকাল। বারিধারা তখন প্রৌঢ়ার দু’চোখেও। তাঁর ক্ষয়াটে আঙুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে খুঁজছে তিরিশ বছর আগের আর একটি হাত-পা আর মুখকে। বছর পঞ্চাশের হরকা বাহাদুর সেই মুহূর্তে দিদি রতি কুমারী কামীর কাছে বছর কুড়ির ভাই। পাভলভের চা-ঘরের এমন আবেগঘন মুহূর্ত বাঁধ ভাঙাল আরও অনেক চোখের। ত্রিশ বছর আগে হারানো ভাইকে ঘরে ফেরাতে প্রথম বার নেপালের রাউতগাঁওয়ের বাইরে এলেন রতি। উড়ানে তাঁর সঙ্গী ছিলেন জামাই ভীম বাহাদুর এবং বোনপো গণেশ নেপালি।
নিজের গ্রাম থেকে আচমকা উধাও হয়ে যান যুবক হরকা। অনেক খুঁজেও সন্ধান মেলেনি। পরিবার ধরেই নিয়েছিল, মারা গিয়েছেন তাদের একমাত্র ছেলে হরকা বাহাদুর। সম্প্রতি তাঁর বেঁচে থাকার বার্তা স্থানীয় থানা মারফত পৌঁছেছিল নেপালের জাজারকোটের রাউতগাঁওয়ের বাসিন্দা হরকা বাহাদুরের বাবা ও বোনের কাছে। ভিডিয়ো কলে ছেলেকে দেখে কেঁদে ফেলেন নবতিপর বাবা। এর পর কাগজকলমের প্রক্রিয়া শেষে এ দিনের সাক্ষাৎ। যার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জড়িয়ে রয়েছে মনোরোগীদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা— ‘অঞ্জলি’। আর পাশে থেকেছেন পাভলভ কর্তৃপক্ষ এবং নেপাল পুলিশ।
হরকার রাউতগাঁওয়ের বাড়ি থেকেই দেখা মেলে হিমালয়ের। টানা তিন দিন হেঁটে এবং খচ্চরের পিঠে চড়ে নেমে তখন গাড়ির দেখা মিলত। এখন অবশ্য জাজারকোট পর্যন্ত পৌঁছলেই বাস মিলবে। গত ন’বছর তিনি পাভলভের আবাসিক, তার আগের ২১ বছর কোথায় ছিলেন? জানা যায়নি। নিরুদ্দেশ হওয়ার পরে দুর্ঘটনায় তাঁর ডান পা ভাঙে। খুঁড়িয়ে চলা হরকা এখন স্কিৎজ়োফ্রেনিয়া এবং ডিমেনশিয়ার রোগী। কথা বলেন খুবই কম।
গত এক মাসে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে নেপালের একাধিক আবাসিক মনোরোগী সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরলেন। সংস্থার তরফে অনিন্দিতা চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আমরা নেপালে গিয়ে দু’জন মহিলা আবাসিককে পরিবারে ফিরিয়ে দিয়েছি। বাকিদের পরিবারে ফেরাতে নেপাল পুলিশের সঙ্গে তখনই যোগাযোগ তৈরি করা হয়েছিল।’’
গত মাসেই পাভলভ এবং লুম্বিনীর আবাসিক রঞ্জিতা চৌধুরী এবং ববিতা দেবীকে নেপালে তাঁদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে ওই সংস্থা। ২০১৬ থেকে বাইপোলার ডিজ়অর্ডার নিয়ে পাভলভে ছিলেন রঞ্জিতা। এক বছর ধরে লুম্বিনীতে ববিতার চিকিৎসা চলছিল নন স্পেসিফিক সাইকোসিসের। এই দু’জনকে নিয়ে বীরগঞ্জ রক্সৌল দিয়ে নেপালে ঢোকেন ‘অঞ্জলি’র সদস্যেরা। বারা জেলার কালাইয়া পুলিশ কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করে তাঁদের বাসস্থানের তথ্য দিয়ে সন্ধান মেলে দুই পরিবারের। কন্ট্রোল রুমে পরিবারের কাছে রঞ্জিতা ও ববিতাকে তুলে দেওয়া হয়।
সুস্থ হয়ে ওঠা একাধিক নেপালি আবাসিকের পরিবারের খোঁজে সাহায্য মেলে তখনই। স্থানীয় থানার সাহায্যে পরিবার খুঁজে আবাসিকের সঙ্গে ভিডিয়ো কলে কথা বলানো হয়। এ ভাবে নেপালে ফিরেছেন পাভলভের সুখরাজ লিম্বু ও শ্যামকুমার তামাং এবং লুম্বিনীর দীপ মঙ্গল।
ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সিনিয়র প্রজেক্ট ম্যানেজার শুক্লা দাস বড়ুয়া বলেন, ‘‘সেই সময়ে কার্ফু চলছিল নেপালে। ভারতের সিম সেখানে কাজ করে না। ভাষাগত সমস্যা ছিল। হোটেলের কর্মীরা ফোন করতে এবং হিন্দিতে অনুবাদ করে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন।’’
ওই সংস্থার তরফে মানসিক স্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মী রত্নাবলী রায় জানান, পুনর্বাসনের দু’টি দিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক। সামাজিক পুনর্বাসন তাঁরা দেখেন। কিন্তু যখন প্রশাসনিক অচলাবস্থা হয়, তখন পুনর্বাসন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত হয়। তিনি বলেন ‘‘বর্তমান পরিস্থিতিতে অসুস্থতাজনিত অনবধানতাও অপরাধ গণ্য হচ্ছে। ফলে, দু’দিক থেকেই কাজটা কঠিন হয়ে উঠছে।’’
কাঁটাতারের এত জটিলতা মানে না অবুঝ মন। তাই ঘরে ফেরার ব্যাকুলতা হরকার চোখে স্পষ্ট। সকলকে হাতজোড় করে নমস্কার করে বার বার দিদির হাতটা আঁকড়ে ধরতেও দেখা গেল। ও দিকে, হরকার বাল্যবন্ধু নেপালের বিদ্যুৎমন্ত্রী শক্তি বাহাদুর বসনেত তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য আয়োজন সেরে ফেলেছেন। তবে কি বন্ধুর ঘরে ফেরার উপহার হিসেবে বিদ্যুৎহীন রাউতগাঁওয়ে পৌঁছবে আলো?