জিতনরাম মাঁঝি, লালু প্রসাদ ও রামবিলাস পাসোয়ান।
প্রবাদটা বাংলায় খুব চালু। কতটা খাঁটি, তা নিয়ে অবশ্য নানা লোকের নানা মত। তবে আপাতত অ-বাঙালি একটি রাজ্যের বাঙালি মহল্লায় প্রবাদটা খুব ঘুরছে। মানে রাজ্যজুড়ে ভোটের বাদ্যি বেজে ওঠার পর নানা ঘটনার সূত্রে!
তাঁরা বলছেন, রাজনীতির বিহারে ‘জামাই নেহি হ্যায় আপনা’। মানে ওই ‘জন, জামাই, ভাগ্না, তিন নয় আপনা’— একটু পাল্টে নেওয়া আর কী! ‘ভাগ্না’দের নিয়ে অবশ্য এখনই এতটা নাটক জমেনি। কিন্তু যুযুধান দুই মহাজোটেই হেভিওয়েট শ্বশুররা মহা ফাঁপরে তাঁদের জামাইদের নিয়ে।
এনডিএ জোটেই ঝামেলাটা বেশি। আর সেটা সব চেয়ে বেগ যাঁকে দিচ্ছে, তিনি লোক জনশক্তি পার্টির নেতা রামবিলাস পাসোয়ান। ভোটের টিকিট না পেয়ে তাঁর দুই জামাই একসঙ্গে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন। বড় জামাই অনিলকুমার সাধুর খুব শখ ছিল ভোটে প্রার্থী হওয়ার। সে আশা ভঙ্গ হতেই স্ত্রী আশাকে সঙ্গী করে আনকোরা এক প্রতিবাদে নামার কথা ঘোষণা করেছেন। অনিল জানিয়েছেন, যে ৪০টি আসনে তাঁর শ্বশুরের দল লোক জনশক্তি পার্টি লড়বে, সেই প্রতিটি এলাকায় তিনি যাবেন। গিয়ে ভোটারদের বলবেন, তাঁরা যেন লোক জনশক্তি পার্টিকে ভোট না দেন। নিজের নাক কেটে শ্বশুরের যাত্রাভঙ্গের এই দুঃসাহস দেখে তড়িঘড়ি অনিলকে ছ’বছরের জন্য দল থেকে সাসপেন্ড করেছেন শীর্ষ নেতৃত্ব।
রামবিলাসের আর এক জামাই মৃণালের নাকি বৈশালী জেলার রাজাপাকর কেন্দ্র থেকে দাঁড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর দেখা যায়, মৃণালের তাতে নাম নেই। ভায়রার মতো অতটা চরমপন্থা এখনও না নিলেও দলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মৃণাল। দুই জামাইবাবুকে বোঝানোর চেষ্টায় নেমেছেন রামবিলাস-পুত্র তথা পার্টির সংসদীয় বোর্ডের সভাপতি চিরাগ পাসোয়ান। তিনি বলেছেন, ‘‘এটা আমাদের পরিবারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। আমরা আলোচনা করেই এর সমাধান করব।’’ সেই সমাধান আদৌ হয় কি না, সেটাই দেখার।
এনডিএ-র আর এক জোটসঙ্গী, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জিতনরাম মাঁঝি অবশ্য সমাধান খোঁজার ধারকাছ দিয়ে যাচ্ছেন না। তাঁর সদ্য তৈরি হওয়া দল হিন্দুস্থান আওয়াম মোর্চা লড়ছে ২০টি আসনে। জিতনরামের জামাই দেবেন্দ্র মাঁঝি বুদ্ধগয়া থেকে টিকিট চেয়েছিলেন। পাননি। তাই নির্দল হয়েই ওই আসনে লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শুনে জিতনরাম বলেছেন, ‘‘এমন জামাইয়ের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের আমি ঘোর বিরোধী।’’
বিপক্ষ জোটের লালুপ্রসাদও পড়েছেন একই বিড়ম্বনায়। তবে তাঁর ছোট জামাই তেজপ্রতাপ সিংহ যাদবের নিতান্তই হাত-পা বাঁধা। তিনি যেমন লালুর ছোট মেয়ে রাজলক্ষ্মীর স্বামী, তেমনই আবার সমাজবাদী পার্টির নেতা মুলায়ম সিংহ যাদবের পৌত্র। সাবেক জনতা পরিবারকে একজোট করে জোটের সলতে পাকিয়েছিলেন মুলায়মই। নীতীশ কুমারকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে মেনে নিতে লালুকে তিনিই রাজি করান। অথচ পরে সেই লালু-নীতীশের বিরুদ্ধেই একতরফা আসন ভাগাভাগির অভিযোগ তুলে জোট ভেঙে বেরিয়ে আসেন তিনি। আলাদা ফ্রন্ট গড়েন শরদ পওয়ারের এনসিপি-র সঙ্গে।
এখন নতুন রাজনৈতিক সমীকরণে শ্বশুরের দলের বিরুদ্ধে মাঠে নামতেই হয়েছে তেজপ্রতাপকে। বিহারে অন্তত গোটা কুড়ি সভা তিনি করবেন বলে দলের তরফে জানানো হয়েছে। এবং অনেকের অনুমান, তেজপ্রতাপের এই প্রচার অভিযান বিহারে জেডিইউ-আরজেডি-কংগ্রেস জোটের সমস্যা বাড়িয়ে তুলবে। বিশেষ করে পূর্ব বিহার এবং সীমাঞ্চল এলাকায় সপা-এনসিপি-পাপ্পু যাদবের জোট শক্তিশালী বলেই মনে করা হচ্ছে।
এই হল জামাই-কাহিনি। তবে তার চেয়েও আকর্ষক একটা বৈশিষ্ট্য রয়েছে গত কাল প্রকাশিত হওয়া প্রার্থী তালিকায়। দু’পক্ষের জোটেই দেখা যাচ্ছে, নিজের বংশের লোকেদের টিকিট দিতে কার্পণ্য করেননি নেতারা। রামবিলাস পাসোয়ানের ভাই পশুপতি কুমার পারশ এবং ভাইপো প্রিন্সরাজ পাসোয়ান ভোটে দাঁড়াচ্ছেন। এমনকী সরিতা পাসোয়ান নামে এক আত্মীয়াও টিকিট পেয়েছেন। কিন্তু ব্রাত্য দুই জামাই। জিতনরাম মাঁঝি টিকিট নিয়ে মনোমালিন্যে জামাইয়ের সংস্রব ত্যাগ করছেন। যদিও নিজে মকদুমপুর কেন্দ্র থেকে দাঁড়াচ্ছেন। ছেলে সন্তোষকুমার সুমনকে প্রার্থী করেছেন কুটুম্বা থেকে। লালুর দুই ছেলে তেজস্বী ও তেজপ্রতাপ প্রার্থী হলেন। অথচ মেয়ে মিসা বা অন্য কোনও জামাই টিকিট পেলেন না।
তবে কি ভোটের বাজারে রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে-জামাইদের তেমন কদর নেই? হিসেব কষতে গেলে ঘুরেফিরে আসছে সেই বাংলা প্রবাদটাই!