করমণ্ডলের এক যাত্রীকে খুঁজতে ম্যাটাডোর ভাড়া করে ওড়িশায় এসেছে হাওড়ার একটি পরিবার। —নিজস্ব চিত্র।
করমণ্ডল দুর্ঘটনার তিন দিন কেটে গিয়েছে। এখনও প্রিয়জনের দেহ খুঁজে হন্যে অনেকে। হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল, মর্গ থেকে মর্গ— সারা দিন চলছে খোঁজ। কেউ কেউ খোঁজ পাচ্ছেন, কেউ খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সোমবার এমনই দৃশ্য চোখে পড়েছে ওড়িশার ভুবনেশ্বর থেকে বালেশ্বর। এর মধ্যেই কী ভাবে অজ্ঞাতপরিচয় দেহগুলো শনাক্ত করা যাবে, তার বিবৃতি দিল রেল।
সোমবার ভুবনেশ্বর এমস-সহ ওড়িশার ৫টি হাসপাতালের মর্গে রাখা রয়েছে অন্তত ১৭০টি দেহ। বেশির ভাগ দেহে দ্রুত পচন ধরছে। সেগুলির সংরক্ষণের চেষ্টা চলছে। এ জন্য পারাদ্বীপ থেকে এসেছে ৫টি কন্টেনার। ওড়িশা প্রশাসনের একটি সূত্র মারফত জানা গিয়েছে, ‘নর্থ ওড়িশা চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’র হলঘরে যে অস্থায়ী মর্গ তৈরি হয়েছে, সেখানে এখনও অন্তত ১২০টি আছে। তবে শেষ পর্যন্ত পাওয়া খবরে তার মধ্যে ৪০টির বেশি দেহ শনাক্ত করেছে মৃতের পরিবার। তবে বিভিন্ন হাসপাতালের বাইরে এখনও শূন্যদৃষ্টিতে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরতে দেখা গিয়েছে অনেককে। শুক্রবার রাতে চেন্নাইগামী করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার খবর পাওয়া ইস্তক কোনও ভাবেই কাছের মানুষের খোঁজখবর করে উঠতে পারেননি এঁরা। এঁদের কেউ এসেছেন বাংলা থেকে। কেউ এসেছেন অন্যান্য রাজ্য থেকে। যেমন, হাওড়ার জগৎবল্লভপুরের বাসিন্দা শঙ্কর দাস।
শুক্রবার করমণ্ডল এক্সপ্রেসে উঠেছিলেন জগৎবল্লভপুরের বাসিন্দা সুমিত মালিক। রেল দুর্ঘটনার পর তাঁর আর খোঁজ পায়নি পরিবার। বিভিন্ন ভাবে যোগাযোগ করেও ২২ বছরের সুমিতের কোনও খবর না পেয়ে সটান ম্যাটাডোর ভাড়া করে হাওড়া থেকে ওড়িশা চলে এসেছেন তাঁর পরিজনরা। শনিবার থেকেই সুমিতের খোঁজ করছেন তারা। সুমিতের প্রতিবেশী শঙ্করের কথায়, ‘‘ওড়িশার বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে দেখলাম। কোথাও আমাদের সুমিতকে পেলাম না।’’ তিনি জানান, করমণ্ডলে চেপে চেন্নাই যাচ্ছিলেন সুমিত। সেখানে শ্রমিকের কাজ করেন তিনি। দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পর সুমিতের মোবাইল নম্বর বার বার ডায়াল করে গিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। না, এক বারও ফোনের ওপার থেকে সাড়া মেলেনি। তাই পরিবারের লোকজন এবং প্রতিবেশীরা সুমিতকে খুঁজতে ম্যাটাডোর নিয়ে পৌঁছে গিয়েছেন ওড়িশায়।
সোমবার দুপুরে সরো হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে আবার অন্য একটি হাসপাতালের দিকে গাড়ি ছুটিয়েছেন শঙ্কর। জানালেন, আগেই বালেশ্বরের হাসপাতাল ঘুরে এসেছেন। ভুবনেশ্বর এমসেও খোঁজ নেওয়া হয়ে গিয়েছে। এখনও খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।
মঙ্গলবার ওড়িশা যাচ্ছেন মমতা:
সোমবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন আবার তিনি ওড়িশায় যাচ্ছেন। মঙ্গলবার কটক এবং ভুবনেশ্বর হাসপাতালে যেখানে রাজ্যের আহত রোগীরা ভর্তি রয়েছেন, তাঁদের দেখতে যাবেন। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে থাকবেন বাংলার আরও দুই মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এবং শশী পাঁজা। সোমবার মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, এখনও পর্যন্ত ২০৬ জন ব্যক্তি, যাঁরা রেল দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন, ওড়িশা থেকে বাংলার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। তাঁদের চিকিৎসা ঠিক মতো হচ্ছে কি না, সেটা দেখতেই ট্রেন দুর্ঘটনার পর দ্বিতীয় বার ওড়িশা আসছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখান থেকে মেদিনীপুরও যেতে পারেন।
দেহ শনাক্তকরণের জন্য বিবৃতি রেলের:
রেল দুর্ঘটনায় যাঁরা এখনও তাঁদের আত্মীয় পরিজনদের হদিশ পাননি, তাঁদের জন্য সোমবার একটি বিবৃতি দিয়েছে রেল। তাতে বলা হয়েছে ওড়িশা সরকারের সহায়তায় ভারতীয় রেল দেহ শনাক্তকরণের কাজে উদ্যোগী হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত যাত্রীদের পরিবারের সদস্য, আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব তাঁদের ফটো ব্যবহার করে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি যাত্রীদের তালিকা এবং অজ্ঞাতপরিচয় দেহের সন্ধান নিতে পারবেন। তার জন্য কয়েকটি ওয়েবসাইট লিঙ্ক দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রেলওয়ের হেল্পলাইন নম্বর ১৩৯-এ যোগাযোগ করা যাবে। এই রেল দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত যাত্রীদের পরিবার/ স্বজনদের সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য সার্বক্ষণিক কাজ করছে। হেল্পলাইন ১৩৯ রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিচালনা করছেন। এছাড়াও, বিএমসির হেল্পলাইন নম্বর— ১৮০০৩৪৫০০৬১/১৯২৯ খোলা থাকছে ২৪ ঘণ্টা।
করমণ্ডল দুর্ঘটনায় ৯০ বাংলাবাসীর মৃত্যু:
বালেশ্বরের ট্রেন দুর্ঘটনায় রাজ্যে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৯০। দেহগুলির শনাক্তকরণও হয়ে গিয়েছে। তার মধ্যে ৭৩টি দেহ রাজ্যে এসে পৌঁছেছে। বাকি দেহগুলির শনাক্তকরণের চেষ্টা চলছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, এই সঙ্কটের মুহূর্তে তিনি রাজ্যবাসীর পাশে রয়েছেন। পূর্ব ঘোষণা মাফিক দুর্ঘটনায় মৃতদের পরিবারকে ৫ লক্ষ টাকা, গুরুতর আহতদের ১ লক্ষ টাকা, তুলনায় কম আহতদের ২৫ হাজার টাকা এবং আতঙ্কে ভুগছেন, এমন ব্যক্তিদের ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন মমতা।
ট্রেনে সবচেয়ে বেশি ছিলেন কাকদ্বীপের বাসিন্দা:
শুক্রবার করমণ্ডল এক্সপ্রেসে এ রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যাত্রী ছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসিন্দা। জেলা প্রশাসনের সূত্র বলছে, সবচেয়ে বেশি যাত্রী ছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপের। এঁদের কেউ রওনা দিয়েছিলেন ভিন্রাজ্যে রাজমিস্ত্রির কাজ নিয়ে। কেউ অন্যান্য কাজ পেয়ে উঠে বসেছিলেন করমণ্ডল এক্সপ্রেসে। কাকদ্বীপ বিধানসভায় এ পর্যন্ত মোট ২৬ জন দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিলেন বলে খবর। যার মধ্যে ৫ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। বাকিদের কেউ কেউ এখনও ওড়িশার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কয়েক জন অল্প চোট-আঘাত নিয়ে ফিরেছেন বাড়ি।