এইচএমপিভি ভাইরাস কী? কতটা ক্ষতিকর? ফাইল চিত্র।
কোভিডের মতোই উপসর্গ। সার্স-কভ ২ বা করোনাভাইরাসের মতোই প্রজাতি। একই রকম রোগ ছড়ায়, তবুও আলাদা। চিনে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়েছে একগুচ্ছ ভাইরাস, যার মধ্যে হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি) নিয়েই চর্চা বেশি হচ্ছে। যদিও চিনের সরকারের তরফে আনুষ্ঠানিক ভাবে কিছু ঘোষণা করা হয়নি এখনও। ওই ভাইরাসটি ঠিক কত জনের মধ্যে ছড়িয়েছে বা তাঁদের অবস্থা কতটা সঙ্কটজনক, সে বিষয়ে এখনও স্পষ্ট ভাবে কিছু জানা যায়নি। সংবাদ সংস্থা এএনআই তাদের একটি প্রতিবেদনে দাবি করেছে, চিনের পরিস্থিতির উপরে নজর রাখছে ভারত। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অধীনস্থ ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজ়িজ় কন্ট্রোল’-কে উদ্ধৃত করে জানানো হয়েছে যে, ভাইরাসটি নিয়ে এখনই এত আতঙ্কের কারণ নেই। শীত বা বসন্তের আগে এমন নানা ধরনের ভাইরাসের উপদ্রব বাড়ে। কাজেই পরিস্থিতি বিচার করেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এখন কথা হল, কেন এই ভাইরাস নিয়ে এত চর্চা হচ্ছে? আমেরিকার ‘সেন্টার ফর ডিজ়িজ় কন্ট্রোল’ (সিডিসি) এবং ভারতের ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিন’-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, এইচএমপিভি-র চরিত্র অনেকটাই করোনাভাইরাসের মতো। হাঁচি-কাশির মাধ্যমেই রোগ ছড়ায় এই ভাইরাস। শরীরে ঢুকলে শ্বাসযন্ত্রেই সবচেয়ে আগে আক্রমণ শানায়। তাই ফের করোনার মতো আরও অতিমারি চলে আসতে পারে কি না, সে নিয়েই আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
করোনার তুতো ভাই অতটাও জাঁদরেল নয়
২০০১ সালে প্রথম এই ভাইরাসটিকে নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। ‘নিউমোভিরিডি’ পরিবারের সদস্য এই ভাইরাস ‘রেসপিরেটারি সিনসিটিয়াল ভাইরাস’ (আরএসভি), রাইনোভাইরাসের সমগোত্রীয়। আরএসভি এবং রাইনোভাইরাস কিন্তু এ দেশে বেশ পরিচিত। প্রতি বছর শীতের সময়ে এ দেশে নানা জায়গায় বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় অজানা জ্বর, শ্বাসকষ্টের কারণ এই দুই ভাইরাস। শিশুদের সবচেয়ে আগে সংক্রমিত করে। এইচএমপিভি অনেকটা তেমনই। জ্বর, নিউমোনিয়া ও শ্বাসজনিত রোগের কারণ হতে পারে এই ভাইরাস।
এইচএমপিভি ভাইরাস ঠিক কেমন? ছবি সূত্র: রিসার্চ গেট জার্নাল।
করোনার মতো আরএনএ (রাইবো-নিউক্লিক অ্যাসিড) ভাইরাস হলেও এইচএমপিভি ততটাও জাঁদরেল হয়ে ওঠেনি বলেই মত বিজ্ঞানীদের। আমেরিকার সিডিসি জানাচ্ছে, করোনার অসংখ্য প্রজাতি ও উপপ্রজাতি। কিন্তু এইচএমপিভি-র দুটি প্রজাতিই এ পর্যন্ত শনাক্ত করা গিয়েছে— ‘এইচএমপিভি-এ’ ও ‘এইচএমপিভি-বি’, যাদের আবার চারটি ভাগ রয়েছে এ১, এ২, বি১ ও বি২। চিনে ঠিক কোন প্রজাতি ছড়িয়েছে, তা এখনও জানা যায়নি।
কোন ঠিকানায় বাস
করোনার মতো এই ভাইরাসের উৎসও পশু বা পাখিদের থেকেই মনে করা হয়। বিশেষ করে পাখিদের থেকে এই ভাইরাস এসেছে বলে মত অনেক বিজ্ঞানীর। সিডিসি ও ভারতের ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজ়িজ় কন্ট্রোল’-এর গবেষণা বলছে, পাখিদের মধ্যে অ্যাভিয়ান মেটানিউমোভাইরাস (এএমপিভি-সি)-এর একটি প্রজাতি রয়েছে, যার সঙ্গে হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাসের বিস্তর মিল। যদিও এ বিষয়ে অনেক রকম মতামতই আছে। অনেক বিজ্ঞানী বলেন, মেটানিউমোভাইরাস নতুন নয়। বরং বহু পুরনো। ২০০ বছর আগেও নাকি এই ভাইরাস ছিল।
মানুষের শরীরে ঢুকলে এই ভাইরাসের একটাই ঠিকানা— শ্বাসনালি ও ফুসফুস। এই দুই জায়গাতেই এরা নিজেদের বিভাজন ঘটিয়ে বংশবৃদ্ধি করে এবং দ্রুত এক জনের থেকে অন্য জনের শরীরে ছড়ায়। আক্রান্তের থুতু, লালা থেকে ভাইরাস ছড়াতে পারে।
যতটা গর্জায় ততটাই কি বর্ষায়?
আগে থেকেই এই ভাইরাস নিয়ে ভয় পেতে নিষেধ করছেন চিকিৎসকরা। এক এক ভাইরাসের দাপট জায়গা বিশেষে এক এক রকম হয়। এ বিষয়ে চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী বলেন, “শীতের সর্দিকাশি, ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বয়স্কদের মরসুমি নিউমোনিয়ার মতোই রোগ ছড়ায় এই ভাইরাস। তবে এখনই ভয় পাওয়ার কারণ নেই। সরকারি তরফে কোনও কিছুই জানানো হয়নি।”
আমেরিকার ‘ন্যাশনাল রেসপিরেটারি অ্যান্ড এন্টেরিক ভাইরাস সার্ভিল্যান্স সিস্টেম’ সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে, এই ভাইরাসের সংক্রমণে প্রচণ্ড শুকনো কাশি হয়, জ্বর থাকে কয়েক দিন, হালকা নিউমোনিয়ার উপসর্গ দেখা দিতে পারে। যতটা জটিল নাম, ততটা এর বহিঃপ্রকাশ নয়। যাঁদের আগে থেকে সিওপিডি বা ফুসফুসের সংক্রমণ আছে, তাঁদের ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট বাড়তে পারে, ব্রঙ্কাইটিসের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। বয়স্কদের শরীরে এই ভাইরাসের প্রভাব বেশি পড়তে পারে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হলে, এইচএমপিভি হাঁপানি বা সিওপিডি-র কারণ হয়ে উঠতে পারে। তখন অক্সিজেন থেরাপি দেওয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে। তবে সেই আশঙ্কা সকলের জন্য নয়।
করোনা তার ‘জেনেটিক মিউটেশন’ (জিনের বিন্যাসের রাসায়নিক বদল) ঘটিয়ে অসংখ্য উপরূপের জন্ম দিয়েছে, যার কয়েকটি রীতিমতো প্রাণঘাতী। কিন্তু এইচএমপিভি-র ক্ষেত্রে তেমনটা বলা যায় না এখনও অবধি।