ঘাড় খুব স্পর্শকাতর, মালিশ করাতে গেলেও বিপদ হতে পারে। কেন সাবধান করলেন চিকিৎসক? প্রতীকী ছবি।
পার্লারে মালিশের আরাম খেতে গিয়েও যে বিপদও ঘনাতে পারে তা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি যুবক। চুল কাটানোর পরে মাথায়, কাঁধে বেশ ভাল করেই মালিশ করে দিচ্ছিলেন সালোঁর কর্মী। আর তা করতে গিয়েই ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটে গেল। মালিশ করার সময়েই ঝুঁকে গেল ঘাড়। মাথা এলিয়ে পড়ল এক দিকে। অচৈতন্য যুবককে তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে জানা যায়, তিনি স্ট্রোকে আক্রান্ত। মাথায় মালিশ করাতে গিয়েও কি স্ট্রোক হতে পারে? চিকিৎসকেরা বলছেন, তা অস্বাভাবিক নয়। এরই নাম ‘সালোঁ স্ট্রোক’ বা ‘বিউটি পার্লার স্ট্রোক’।
এই ঘটনা কর্নাটকের। হাসপাতালে সঠিক সময়ে চিকিৎসার পরে যুবক এখন কিছুটা সুস্থ। তবে তাঁর শরীরের বাঁ দিকের অংশ অনেকটাই দুর্বল। কথা বলতেও সমস্যা হয় তাঁর। জানা গিয়েছে, ঘাড় হেলিয়ে চাপ দিয়ে মালিশ করার সময়ে ক্যারোটিড ধমনী ছিঁড়ে যায়। ফলে রক্তবাহিকাগুলিতে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। আচমকাই মস্তিষ্কে রক্ত ও অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, স্ট্রোকে আক্রান্ত হন যুবক।
এই বিষয়ে স্নায়ুরোগ চিকিৎসক অনিমেষ কর আনন্দবাজার অনলাইনকে বলছেন, “ঘাড়কে চিকিৎসার পরিভাষায় বলে ‘সারভাইকাল স্পাইন’। মস্তিষ্কে রক্ত পৌঁছে দেওয়ার পথ এটি। এর মধ্যে দিয়ে অজস্র শিরা-ধমনী মস্তিষ্কে রক্ত সবরাহ করে। আসলে সার্ভাইকাল স্পাইন শরীরের এক অত্যন্ত জটিল অংশ। এর মধ্যে দিয়ে অজস্র সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রক্তবাহী শিরা, ধমনী ও স্নায়ু রয়েছে। ঘাড় খুবই স্পর্শকাতর। শরীরের এই অংশে জোরে চাপ দিলে অথবা আঘাত লাগলে এই শিরা, ধমনী বা স্নায়ুর জাল ছিঁড়ে যেতে পারে। তখন মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটে স্ট্রোক হতে পারে।”
এই ঘটনা কিন্তু প্রথম নয়। ১৯৯৩ সালে ‘বিউটি পার্লার স্ট্রোক সিনড্রোম’-এ মৃত্যু হয়েছিল আরও এক মহিলার। ২০২২ সালেও এমন ঘটনা ঘটে। সালোঁতে চুলে শ্যাম্পু করাতে গিয়ে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন এক মহিলা। এই সবই হয়েছিল রক্তবাহী ধমনীগুলিতে আঘাত লাগার কারণেই।
চিকিৎসের মতে, মালিশ করার সময়ে ঘাড় ও মাথার সংযোগস্থলে যখন জোরে চাপ দেওয়া হয়, তখন সংবেদনশীল রক্তবাহিকাগুলিতে চাপ পড়েই এমন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ভার্টিব্রাল ধমনী দিয়ে মুখের পেশি এবং মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ হয়। এই ধমনী যদি কোনও কারণে সঙ্কুচিত হয় বা ছিঁড়ে যায়, মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ কমে বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিতে পারে। একে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়, ‘ভার্টিব্রাল আর্টারি ডিসেকশন’। অপটু হাতে ঘাড়ে চাপ দিয়ে মালিশ, ঘাড় বেশি ঝুলিয়ে বা হেলিয়ে রেখে তাতে চাপ দেওয়া অথবা আঘাত বা দুর্ঘটনার কারণেও ‘ভার্টিব্রাল আর্টারি ডিসেকশন’ হতে পারে। তখন মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে অক্সিজেনের অভাবে রোগীর স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এমনকি এমনও দেখা গিয়েছে, রক্তবাহী ধমনী ছিঁড়ে যাওয়ার কারণে আচমকাই হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে গিয়েছে রোগীর।
অনিমেষবাবু জানাচ্ছেন, কেবল ঘাড় হেলিয়ে রাখলেই যে স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা থাকবে তা নয়, বসে থেকে বা শুয়ে ঘাড়ে-কাঁধে মালিশের সময়েও এমন হতে পারে। আসলে, সকলের হাড় ও পেশির গঠন সমান হয় না। বিশেষ করে ঘাড়ের কাছে স্নায়ু ও রক্তবাহী ধমনীর বিন্যাস এমন যে, সেখানে যদি খুব জোরে আঘাত লাগে, তা হলে যখন তখন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বয়স্কদের চিকিৎসার সময়েও এই বিষয়টি খেয়াল রাখা হয়। ঘাড় হেলিয়ে বা বেঁকিয়ে কোনও কিছু পরীক্ষা করার সময়ে খুবই সতর্কতার সঙ্গে তা করা হয়। তাই সালোঁতে গিয়ে মালিশ করাতে হলে তা অভিজ্ঞ হাতেই করা উচিত। বেকায়দায় আঘাত লেগে গেলে তা প্রাণসংশয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারে।