সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিপূর্ণ ডায়েট চার্ট দেখে নিন। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পুজোর আর হাতেগোনা কয়েক দিনই বাকি। এত তাড়াতাড়ি অনেকটা ওজন কমিয়ে ফেলা সম্ভব নয়। তা স্বাস্থ্যকরও হবে না। যদি শরীরচর্চার সময় না থাকে, তা হলে খাওয়াদাওয়ায় নিয়ন্ত্রণ এনে ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে ২-৩ কেজি পর্যন্ত ওজন কমানো সম্ভব। তা-ই বা কম কী! যাঁরা মেদ ঝরাতে হিমশিম খাচ্ছেন, কোনও টোটকাই কাজে আসছে না, তাঁরা এই পদ্ধতি মেনে চলতে পারেন।
ওজন কমানো নিয়ে চিন্তায় থাকেন অনেকেই। পুষ্টিবিদ শম্পা চক্রবর্তী আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, “পুজোর ক’টা দিন সকলেই চান বাইরে ভালমন্দ খেতে। বাড়িতেও বেশ জমিয়ে ভূরিভোজ চলে। তাই পুজোর সময়ে যদি পছন্দের খাবার খেতেই হয়, তা হলে আগের কয়েকটা দিন একটু নিয়ম মেনে চলা ভাল। তা হলে আর চিন্তা থাকবে না। শরীরও একদম সুস্থ ও ঝরঝরে থাকবে।”
সকাল থেকে রাতের খাওয়াদাওয়া
ঘুম থেকে উঠে ডিটক্স পানীয়
সকালে ঘুম থেকে উঠে সবচেয়ে আগে জরুরি ডিটক্স পানীয়। ছোট ছোট করে ফল কেটে তা সারা রাত জলে ভিজিয়ে রেখে সকালে খাওয়া যেতে পারে। অথবা মৌরি-মেথি ভেজানো জল, ত্রিফলা চূর্ণের জল বা উষ্ণ জলে লেবুর রস মিশিয়েও খেতে পারেন। সবই ডিটক্স পানীয়।
উপকারিতা: একাধিক উপকারিতা আছে ডিটক্স পানীয়ের। শরীরের দূষিত পদার্থ বা টক্সিন দূর হবে, হজম ভাল হবে, অম্বলের সমস্যা কমবে, বাড়তি মেদ ঝরবে এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থাকলে তা দূর হবে। সারা দিন যা খাবেন, তা ভাল ভাবে হজম হবে।
চা-কফি ও তার বিকল্প
চা বা কফি খাওয়ার অভ্যাস থাকলে দুধ এবং চিনি একদম বন্ধ করে দিন। শম্পার পরামর্শ, “যে ১৫-২০ দিন কড়া ডায়েট মানবেন, সেই ক’টা দিন চিনি একদম ছোঁবেন না। চা খেলে লিকার বা গ্রিন টি, কফির নেশা থাকলে দুধ-চিনি ছাড়া কালো কফি খেতে হবে।” ময়দার বিস্কুট খাওয়া একদমই চলবে না। চা বা কফির সঙ্গে বিস্কুট খেতে হলে ক্রিমক্র্যাকার বিস্কুট অথবা থিন অ্যারারুট বিস্কুটই খেতে পারেন। অথবা তিন থেকে চারটি ভেজানো কাঠবাদাম খেতে পারেন। শুকনো খোলায় ভাজা ছোলাও চলবে। এতে শরীরে যেমন ফাইবার ঢুকবে, তেমনই ভিটামিন বি ও সি-ও পাবেন।
চা বা কফি না খেলে তার বিকল্প হিসাবে ডবল টোন্ড দুধ খেতে পারেন। অনেকেই হয়তো সকালে সামান্য কিছু খেয়ে পড়তে বসেন অথবা কাজ শুরু করেন। প্রাতরাশ খেতে ৯টা বা সাড়ে ৯টা বেজে যায়। তাঁরা দুধের সঙ্গে এক চামচ ওট্স মিশিয়ে খেতে পারেন, অথবা দুধে অল্প ছাতু গুলে খেতে পারেন। এতে পেট কিছু সময়ের জন্য ভর্তি থাকবে।
প্রাতরাশেই পুষ্টি
প্রাতরাশ ভাল করে করতেই হবে। সবচেয়ে ভাল হয় ডবল টোন্ড দুধে ওট্স মিশিয়ে পরিজ বানিয়ে খেলে। অথবা দইয়ের সঙ্গে ওট্স মিশিয়ে যে কোনও মরসুমি ফল ছোট ছোট করে কেটে উপরে ছড়িয়ে দিন। ফলের মধ্যে আপেল, নাশপাতি, পেঁপে, আঙুর, জাম, আনারস খুব ভাল। ওজন বেশি হলে কলা খাবেন না। কলাতে ক্যালোরি একটু বেশি বলে কম খেতে হবে। পরিজে চিনি, মধু, গুড় বা কোনও রকম মিষ্টি জাতীয় কিছু মেশানো চলবে না।
পরিজ পছন্দ না হলে, ঝাল ঝাল কিছুও খেতে পারেন। তবে ওট্সই খেতে হবে। পুষ্টিবিদ বলছেন, ১৫ দিন প্রাতরাশে কেবল ওট্স খেয়ে দেখুন, ফল হাতেনাতে পাবেন। ওট্সের অমলেট বা চিলা ভাল লাগবে। ওট্স গুঁড়ো করে নিয়ে তার সঙ্গে গাজর, বিনস, ক্যাপসিয়াম, পেঁয়াজ কুচি মিশিয়ে খুব কম তেলে ননস্টিক প্যানে ভেজে নিতে পারেন।
ওজন যদি অনেকটাই বেশি হয়, তা হলে দানাশস্যের বদলে সব্জি আর ডিম দিয়ে অমলেট বানিয়ে খেতে পারেন। উপরে ছড়িয়ে দেবেন শসা। শুধু সেটিই খাবেন প্রাতরাশে। এতে সব্জি থেকে ফাইবার আর ডিম থেকে ভিটামিন, খনিজের চাহিদা মিটে যাবে।
অফিসে বা কাজে যাচ্ছেন যাঁরা, তাঁরা অনেক সময়েই সকালে ভাত খেয়ে বেরোন। যদি ভাত খেতে হয় তা হলে পরিমাণটা যেন এক কাপের বেশি না হয়। ভাত ভাল করে ফ্যান ঝরিয়ে নিতে হবে। স্টার্চ বেশি থাকলেই মেদ বাড়বে। সঙ্গে থাকবে শুধু দু’রকম পদ। যদি মাছ খান, তা হলে সব্জি দিয়ে মাছের ঝোল খান। নিরামিষ খেলে পনিরের তরকারি, সঙ্গে ডাল খান। দই-ভাতও খেতে পারেন।
প্রাতরাশের পর খিদে পায়?
‘মিড-মর্নিং’ বা মাঝামাঝি সময়ের খিদে মেটাতে অনেকে রকম খাবারের কথাই বলা হয়। কিন্তু যাঁরা কঠোর ভাবে ওজন কমাবেন বলে স্থির করেছেন, তাঁরা ওই মাঝামাঝি সময়টাতে খিদে পেলে শুধু জল খান। এর চেয়ে ভাল আর কিছু হতে পারে না। জল খেলে হজমশক্তি বাড়বে। জলে লেবুর রস মিশিয়েও খেতে পারেন, অথবা ডাবের জল খান। এই সময়টাতে ভাজাভুজি বা স্ন্যাকস খেয়ে ফেললেই মুশকিল। ডায়েটে আর কোনও উপকারই হবে না।
যখন-তখন মন খাই খাই করলে এমন কী খাবেন যা স্বাস্থ্যকর? ছবি: ফ্রিপিক।
দুপুরে থরে থরে পদ নৈব নৈব চ
দুপুরের খাওয়াতেও দুটিই পদ রাখতে হবে। যদি ভাতের সঙ্গে ডাল খান, তা হলে আর মাছ খাবেন না। বেশি প্রোটিন খাওয়া চলবে না। সব্জি সিদ্ধ দিয়ে ভাত সঙ্গে তরকারির ঝোল রাখতে পারেন। সবই কম তেলে রান্না হতে হবে আর নুন কম খেতে হবে। চিনি একদমই নয়। চিকেন খেলে সব্জি দিয়ে চিকেন স্ট্যু আর ভাত, এর বেশি কিছু নয়। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে খেতে ইচ্ছে হলে, ভাতের সঙ্গে সব সব্জি মিশিয়ে চিকেন বা ডিম দিয়ে ফ্রায়েড রাইস করে খেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে ভাত এক কাপই নিতে হবে, আর এক কাপ সব্জি— দু’কাপেই পুষ্টির চাহিদা মিটে যাবে। সঙ্গে রাখতে পারেন টক দই বা স্যালাড অথবা রায়তা। স্যালাড বা রায়তা থেকে একবারে ৩০-৪০ ক্যালোরি পেয়ে যাবেন।
ভাজাভুজির সঙ্গে আড়ি
বিকেল হলেই মনটা কেমন খাই খাই করে। সে বাড়িতেই থাকুন বা কাজের জায়গায়। এই সময়েই তাই ফুচকা, ঘুঘনি বা ভাজাভুজি, ফাস্ট ফুড খেয়ে নেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। শম্পা বলছেন, ‘‘বিকেলে শুধু ফল খান। একটি বা দু’টি মরসুমি ফল কেটে নুন-গোলমরিচ দিয়ে খেয়ে দেখুন, মন্দ লাগবে না।’’
স্কুল বা কলেজপড়ুয়ারা বাড়ি ফিরে বিকেলে বা সন্ধ্যায় ছাতু, অথবা দই-খই বা দুধ-কর্নফ্লেক্স খেতে পারে। তা হলে শরীও হালকা থাকবে, পেটভার হবে না। পড়াশোনাতেও মন বসবে।
রাতে সাধারণ খেলেই চেহারা হবে অসাধারণ
রাতে দেরিতে খাওয়ার অভ্যাস আগে ছাড়তে হবে। রাতের খাওয়া সারতে হবে সাড়ে ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে। পুষ্টিবিদের পরামর্শ, রাতে হাতে গড়া দুটি রুটি, সঙ্গে এক বাটি চিকেন স্ট্যু, অথবা মাছের ঝোল খেতে পারেন। নিরামিষের মধ্যে পনির বা সয়াবিনের তরকারি অথবা সব সব্জি মিশিয়ে তরকারি বানিয়ে খেতে পারেন। সঙ্গে থাকবে এক গ্লাস দুধ। যদি দুধ হজম না হয়, তা হলে স্যালাড বা রায়তাও চলবে। রুটি শুধু আটার না খেয়ে আটার সঙ্গে ওট্স মিশিয়ে নিলে ভাল হয়। কিন্তু ময়দা একেবারেই চলবে না।
রুটি অনেকেরই হজম হয় না। সে ক্ষেত্রে ভাত খেতে পারেন। তবে দুপুরের খাওয়ার মতোই এক কাপ ভাতের সঙ্গে যে কোনও এক রকম তরকারি, মাছ বা চিকেনের ঝোল। যদি ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় ১৫ থেকে ২০ কেজি বেশি হয়, তা হলে রাতে ভাত বা রুটি কোনওটিই চলবে না। সব সব্জি দিয়ে স্যালাড বানিয়ে খেতে পারেন, অথবা এক বাটি সব্জি-ডাল মিশিয়ে খেতে পারেন। শুধু সব্জি সেদ্ধ করে গোলমরিচ ছড়িয়ে খাওয়া যেতে পারে।
ওজন নিয়ে কোনও দিনই তেমন বিচলিত ছিলেন না জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চের প্রাক্তন বিজ্ঞানী দীপিকা সুর। তিনি বললেন, “ওজন কমানোর চেয়েও সুস্থ থাকা বেশি জরুরি। সকলের ক্ষেত্রে একই রকম ডায়েট প্ল্যান কাজ করবে না। তাই আপনি কখন ঘুমোতে যান, কখন ওঠেন ঘুম থেকে, সারা দিনের রুটিন কেমন, তার উপরেও অনেক কিছু নির্ভরশীল। সে জন্যই বুঝে খেতে হবে ও পরিমিত খেতে হবে। তা হলে ওজনও কমবে এবং শরীরও ভাল থাকবে।” চিকিৎসকের কথায়, ওজন কমাতে উপোস করা চলবে না। এখন বিভিন্ন রকম ডায়েটের পদ্ধতি বেরিয়ে গিয়েছে। কিটো ডায়েট, ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং হরেক রকম নাম। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা উপোস করে ওজন কমাতে চাইলে তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ, তখন শরীরে ভিটামিন ও খনিজের চাহিদা পূরণ করতে হলে বিশেষ রকম ডায়েট প্রয়োজন। পুষ্টিবিদের সঙ্গে পরামর্শ না করে নিজে থেকে শুরু করলে, বিপদ হতে পারে। এমন অনেক মহিলাই আসেন, যাঁরা সমাজমাধ্যমে বিভিন্ন রকম ডায়েট দেখে তা করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। হরমোনের চক্র বদলে যায়। তখন ওষুধ ও সাপ্লিমেন্ট দিয়ে শরীর সারাতে হয়।
নিয়মমাফিক রোজকার জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়েই ওজন কমানো জরুরি। একেবারে হঠাৎ কয়েক কেজি ওজন কমিয়ে ফেললে শরীরও তার অনুরূপ বন্দোবস্ত করতে পারে না। ফলে আচমকাই রক্তচাপ কমতে পারে, হৃৎস্পন্দনের হার বেড়ে যেতে পারে এবং তার থেকে হৃদ্রোগ হওয়ার আশঙ্কাও প্রবল। তাই পুষ্টিকর ও সুষম খাবার খেয়েই ওজন কমাতে হবে।