গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
বহুজাতিক সংস্থার অতিরিক্ত কাজের চাপ সহ্য করতে না পেরে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মহারাষ্ট্রের ২৬ বছরের অ্যানা সেবাস্টিয়ান, অন্তত এমনই অভিযোগ তরুণীর পরিবারের। পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট অ্যানা চলতি বছরের মার্চে একটি নামী বহুজাতিক সংস্থায় যোগ দেন। অল্পবয়সি তরুণীর অকালমৃত্যু ঘিরে এখন উত্তাল গোটা দেশ। বহুজাতিক সংস্থাটির শাস্তির দাবিতে অনেকেই সুর চড়াতে শুরু করেছেন, ঘটনার তদন্ত নেমেছে কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রকও। অ্যানা একা নন, অ্যানার মতো অতিরিক্ত কাজের চাপের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরছেন দেশের সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার লক্ষ লক্ষ কর্মী। অফিসে ঢোকার সময় নির্ধারিত হলেও বেরোনোর সময়ের কোনও ঠিক থাকে না। আট ঘণ্টার ‘ডিউটি আওয়ার্স’, সে তো শুধু খাতায়কলমে, বাস্তবে তার প্রয়োগ হয় না বললেই চলে।
দিনের পর দিন চলছে এই অব্যবস্থা, অথচ তা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবছে না বেসরকারি সংস্থাগুলি। সরকারও এই ব্যাপারে উদাসীন। তরুণীর মৃত্যুর পর এমন অভিযোগ শোনা যাচ্ছে নানা দিক থেকে। কিন্তু কতটা বেশি কাজ করলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে? তা-ও ভাবাচ্ছে অনেককে। আনন্দবাজার অনলাইন কথা বলল চিকিৎসক, মনোবিদ ও যাপনসহায়কের সঙ্গে।
আচ-আট-আটে দিনটিকে ভাগ করতে বলছেন চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী। তিনি বলেন, ‘‘১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিকেরা দিনে আট ঘণ্টার বেশি কাজ করবে না বলে আন্দোলন করেছিলেন। তাঁদের স্পষ্ট দাবি ছিল, আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা বিনোদন আর আট ঘণ্টার বিশ্রাম চাই। এটাই কিন্তু সুস্থ ভাবে জীবনযাপন করার আদর্শ নিয়ম হওয়া উচিত। এই আন্দোলনের ফলেই কিন্তু পরবর্তী কালে বিভিন্ন দেশ কর্মচারীদের জন্য কমবেশি আট ঘণ্টার কাজের সময় বরাদ্দ করেছে। আট ঘণ্টার বেশি কাজ করলে কিন্তু কেবল শারীরিক ধকল হয় না, মানসিক স্বাস্থ্যও ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি কাজ করালে কর্মীর ডায়াবিটিস, স্থূলতা, হার্টের সমস্যা, ফ্রোজ়েন শোল্ডারের পাশাপাশি মানসিক সমস্যাও শুরু হতে পারে। এ সবের কারণে কিন্তু মৃত্যু-ঝুঁকিও বাড়ে। তাই সব কর্মক্ষেত্রেই ৮ ঘণ্টার বেশি যেন কর্মীদের কাজ করানো না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে আরও কঠোর আইন আনতে হবে সরকারকে।’’
দশটা-পাঁচটার সরকারি অফিস হোক বা কর্পোরেট সেক্টরের টানা ন’-দশ ঘণ্টার শিফ্ট, দিনের বেশির ভাগ সময়টাই কাটছে অফিসে। তাই ধকল, উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তা জীবনের সঙ্গে না চাইতেও জড়িয়ে পড়েছে। কাজের চাপে রাতের পর রাত ঘুম আসে না। কর্মজীবনের এই প্রবল চাপ প্রভাব ফেলে ব্যক্তিগত ও সাংসারিক জীবনেও। ছোট-বড় যে কোনও সংস্থাতেই কাজের চাপ ক্রমবর্ধমান, আর সেই চাপের সঙ্গে শরীর আর মন কোনওটিই যেন আর মানিয়ে নিতে পারছে না। দেশ জুড়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসকদের তো একটানা ৩৬ ঘণ্টা কাজ করে যেতে হচ্ছে মুখ বন্ধ করে। অথচ সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টার ‘ডিউটি আওয়ার্স’ তো তাঁদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। নিয়ম মানা হচ্ছে কোথায়? অ্যানার মৃত্যুর পর ‘ডেলয়েট’ সংস্থার এক প্রাক্তন কর্মী জয়েশ জৈন এক্সে একটি পোস্ট করে বলেছেন, ‘‘ওই সংস্থায় আমি একটানা ২০ ঘণ্টা কাজ করতাম, অথচ খাতায়কলমে ১৫ ঘণ্টার বেশি দেখানো হত না। অ্যানা কোন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন, আমি ভাল ভাবে অনুভব করতে পারছি। সংস্থার কাছে তুমি কেবলমাত্র এক জন সাধারণ কর্মী, কিন্তু পরিবারের কাছে তুমি সব। কর্পোরেট জীবন বড় কঠিন। আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি যে, আমি এই কাজ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছি।’’
অতিরিক্ত কাজের চাপের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েও কী ভাবে সুস্থ থাকবেন কর্মীরা? ছবি: সংগৃহীত।
এমন পরিস্থিতিতে কর্মীদের কী করণীয়? বদল আনা কি আদৌ সম্ভব? সুবর্ণ বলেন, ‘‘মুখ বন্ধ করে সংস্থাগুলির অত্যাচার সহ্য করলে চলবে না। কর্মীদের সংগঠিত ভাবে আন্দোলন করতে হবে। আন্দোলনই দাবি আদায় করার একমাত্র পথ। রাজ্য জুড়ে চিকিৎসকদের আন্দোলন তাঁর স্পষ্ট উদাহরণ বলা যেতে পারে। তা ছাড়া, ব্যক্তিগত ভাবেও আমাদের আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে। কারখানায় যে শ্রমিক কাজ করছেন, তার পরিশ্রম আর অফিসের ডেস্কে বসে যিনি কাজ করছেন, তাঁর পরিশ্রমের মাপকাঠি সমান নয়। সে রকমই তাঁদের শারীরিক সমস্যাগুলিও এক হয় না। তাই ব্যক্তিগত সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করতে হবে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর যাতে কর্মীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের পরীক্ষা হয়, তা নিশ্চিত করার দায়ভার নিতে হবে। দেশে এই সংক্রান্ত আইন আছে, তবে তা মানা হয় না। কর্মীদের নিজেদের অধিকারগুলি আদায় করতে জানতে হবে।’’
অতিরিক্ত কাজের চাপের সঙ্গে বাড়তি মানসিক চাপের সম্পর্ক গভীর। দীর্ঘ দিন ধরে একটানা অতিরিক্ত কাজ করতে করতে শরীর ও মন, দুই-ই ক্লান্ত হতে শুরু করে। তবে আমরা সেই ক্লান্তির উপসর্গগুলি কোনও কোনও ক্ষেত্রে বুঝে উঠতে পারি না, কখনও আবার বুঝেও অবহেলা করি। যা পরবর্তী ক্ষেত্রে বড় রকম শারীরিক ও মানসিক সমস্যার কারণ হয়ে ওঠে। কোন কোন উপসর্গ দেখলে সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন আছে? মনোসমাজকর্মী মোহিত রণদীপ বলেন, ‘‘কাজের চাপ অতিরিক্ত বেড়ে গেলে তার প্রভাব শরীর ও মনের উপর পড়তে শুরু করে। শারীরিক ক্ষেত্রে ক্লান্তি আসতে পারে, হাত-পা ঘেমে যেতে পারে বা ঠান্ডা হয়ে যেতে পারে। মাথা যন্ত্রণা হতে পারে, পেটের সমস্যা, হজমজনিত সমস্যা বড় আকারে দেখা দিতে পারে। মানসিক ক্ষেত্রেও এমন কিছু কিছু বদল লক্ষ করা যায়। যেমন, কাজে মনোযোগ কমে যাওয়া, স্মৃতিশক্তি কমতে থাকা, মনের মধ্যে সারা ক্ষণ একটা ভয়, উদ্বেগ কাজ করা, হতাশায় ভোগা, বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়া, অবসাদে ভোগা। এমনটা দীর্ঘ দিন চলতে থাকলে মানুষের চিন্তাধারা কিন্তু নেতিবাচক দিকে বইতে শুরু করে। আমাকে কেউ বোঝে না, আমার পাশে কেউ নেই, আমি সম্পূর্ণ একা— এই চিন্তাগুলিই মাথায় ঘুরপাক খায়। অ্যানার সঙ্গে যেই ঘটনা ঘটেছে, তার প্রভাবে অ্যানার মতো আর চার-পাঁচ জনের মনেও সংশয় তৈরি হয়েছে। অ্যানার মতো পরিস্থিতিতে তো আমিও আছি, তা হলে আমিও কি শেষ পর্যন্ত এই পথই বেছে নেব— এমন চিন্তা অনেকের মনেই আসছে। দেশের বেশির ভাগ সংস্থায় কর্মীদের এই সমস্যাগুলি বোঝার জন্য কোনও সংগঠন নেই, এটা সত্যিই অসন্তোষজনক। ‘হাইব্রিড মোড’-এ কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে অফিস থেকে বাড়ি ফিরেও শান্তি নেই কর্মীদের। রাত ২টো-৩টে অবধি চলছে কাজ। ফলে ঘুমের বারোটা বাজছে। আর এই কারণে শারীরিক নানা সমস্যার পাশাপাশি স্মৃতিশক্তির সমস্যা বাড়ছে, মৃগীর মতো স্নায়বিক রোগের ঝুঁকিও বাড়ছে। কর্পোরেট সংস্থাগুলির লোভের কোনও শেষ নেই। কর্মীদের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে কিন্তু সরকারকে এ বিষয় আরও বেশি সজাগ হতে হবে, সংস্থাগুলির পাশাপাশি সরকারও কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাদের দায়ভার এড়িয়ে যেতে পারে না। আর কর্মীদের বলব জোট বাঁধতে। কর্পোরেট সংস্থাগুলির জুলুম বন্ধ করতে একসঙ্গে জোটবন্ধ আন্দোলন ছাড়া সত্যিই কোনও উপায় নেই।’’
কাজের চাপে শরীরের ক্ষতি কমাতে কী কী কৌশল মানতে পারেন কর্মীরা?
· ঘুমের সময়ের সঙ্গে কোনও রকম আপস করা চলবে না।
· কাজের মাঝেও মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে।
· নিজের মধ্যে বদলগুলি চিহ্নিত করে বুঝতে হবে মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে কি না।
· নিয়ম করে খোলা জায়গায় প্রাণায়াম করতে হবে।
· মানসিক চাপ কমানোর জন্য নানা রকম ধ্যানের প্রক্রিয়া আছে, ইচ্ছে করলে সেইগুলি শিখেও নিয়ম করে অভ্যাস করতে পারেন।
· খাওয়া, ঘুম, জল খাওয়ার মতো কাজগুলি কিন্তু সময় মতো করতে হবে। খাওয়ার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর ডায়েটে অভ্যস্ত হতে হবে।
· কর্মক্ষেত্রে ‘টাইম ম্যানেজমেন্ট’, অর্থাৎ সময়ের কাজ সময়ে করার অভ্যাস করতে হবে।
· মনের মধ্যে কোনও রকম নেতিবাচক চিন্তা এলেই সময় অপচয় না করে মনোবিদের পরামর্শ নিন।
কর্মক্ষেত্রে একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। লক্ষ্য একটাই, আর্থিক উন্নতি। সেই লক্ষ্যেই তো এত কাজের চাপ মেনে নেওয়া, এত মানসিক টানাপড়েনের সঙ্গে আপস করে চলা। কখনও ভেবে দেখেছেন যে, কাজ দিনের পর দিন করে চলেছে, তা শেষ পর্যন্ত আপনাকে আনন্দ দিতে পারছে তো? পুষ্টিবিদ ও যাপন সহায়ক অন্যন্যা ভৌমিক বলেন, ‘‘অনেকেই আছেন যাঁরা নিজেদের কাজকে ভালবেসে করেন, আবার কেবলমাত্র উপার্জনের জন্য চাকরি করছেন এমন লোকের সংখ্যাও কম নন। কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা কর্মক্ষেত্রে নাম হলেই আনন্দিত হন। আবার কেউ কেউ আছেন যাঁরা নিজেদের কাজটা মোটেই ভালবাসেন না। সে ক্ষেত্রে কাজ করলে মানসিক চাপ কিন্তু নিজে থেকেই তৈরি হবে। সবার মানসিক চাপ নেওয়ার ক্ষমতাও এক রকম না। তাই আমি আর চাপ নিতে পারছি না, সেই বোধটা তৈরি করে নিজেকে সেই কাজটি থেকে সরিয়ে আনার সিদ্ধান্তটা নিতে হবে। কোনও কোনও সংস্থার তরফে কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের তোয়াক্কা না করেই অত্যধিক কাজের চাপ দেওয়া হয়, এই সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু সব সময় কিন্তু মানসিক চাপের জন্য সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দায়ী করা যায় না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে গলদটা কিন্তু ব্যক্তিগত জায়গাতেও থাকে। চাকরি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমরা যদি আরও একটু বেশি সতর্ক হই, তা হলে এই সমস্যা খানিকটা হলেও কমতে পারে। যে কাজ করে আপনি সুখ পাবেন, সেই কাজে আপনার মানসিক ধকলও কম হবে। সে ক্ষেত্রে কেরিয়ার কাউন্সেলিং এবং নিজের পছন্দের বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করাটা ভীষণ জরুরি। এর পাশাপাশি, আমাদের পদোন্নতি হলে কাজের চাপ বাড়বে সেটা স্বাভাবিক— আপনি সেই চাপ নিতে মানসিক ভাবে প্রস্তুত কি না, সেটাও ভাবা দরকার। আপনার কাছে কোনটা প্রাধান্য পাবে, সেটা আপনাকেই ঠিক করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিজের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। পদোন্নতি নিলে জীবনের অন্যান্য পছন্দের কাজগুলিতে সময় কম কম দিতে পারবেন, সেই বিষয় মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকলে তবেই সে দিকে এগোনো উচিত।’’
সবার উপরে শরীর সত্য
এত আলোচনার কারণ একটাই। অতিরিক্ত কাজের চাপের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েও কী ভাবে সুস্থ থাকবেন কর্মীরা? এ ক্ষেত্রে শরীরকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। আর তার জন্য চাই সচেতনতা। এক জন বিমানকর্মীর জীবনচক্র আর এক জন সাংবাদিকের জীবনচক্র কিন্তু এক নয়। তাই নিজেদের পেশা অনুযায়ী শারীরিক ও মানসিক সমস্যাও আলাদা হয়। এর জন্য কিন্তু চিকিৎসক, পুষ্টিবিদ ও মনোবিদের সাহায্য নেওয়া জরুরি। কারণ, তাঁরাই আপনার জীবনচক্র শুনে আপনার ভাল থাকার পথের হদিস দিতে পারেন। সাহায্য চাইতে অনেকেই দ্বিধাবোধ করেন। তবে বাস্তব পরিস্থিতিতে আমাদের কারও কাছ থেকে মানসিক বিষয়ক সাহায্য, কারও কাছ থেকে শারীরিক বিষয়ক সাহায্য আর কারও কাছ থেকে সামাজিক সাহায্য নিতেই হবে। সমস্যাগুলি শরীরে ও মনে চেপে না রাখে, সাহায্য চেয়ে এক হাত বাড়ালেই কিন্তু অনেক সমস্যার সমাধান সহজ হবে।