Andropause

ভয় পেয়ো না অ্যান্ড্রোপজ়ে

ডা. মণ্ডল জানাচ্ছেন, “আমাদের রক্তে দু’ধরনের প্রোটিন চলাফেরা করে বেড়ায়— একটি অ্যালবুমিন এবং অন্যটি গ্লোবিউলিন।

Advertisement

সৌরজিৎ দাস

শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০২৩ ০৮:২০
Share:

ঋতুস্রাব নারীদেহের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট বয়সের পরে (সাধারণত ৪৫ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে) এই ঋতুচক্র স্থায়ী ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। নারীরা হারান তাঁদের প্রজনন ক্ষমতা। এই শারীরিক প্রক্রিয়াটিকে আমরা চিনি ‘মেনোপজ়’ নামে। নারীদের ‘মেনোপজ়’-এর প্রক্রিয়াটি ঘটে পুরুষদের ক্ষেত্রেও। একে বলা হয় ‘অ্যান্ড্রোপজ়’। মেনোপজ়ের ক্ষেত্রে যেখানে নারীদের ইস্ট্রোজেন, প্রজেস্টেরন হরমোনের মাত্রা কমে, সেখানে পুরুষদের অ্যান্ড্রোপজ়-এর ক্ষেত্রে হ্রাস পায় টেস্টোস্টেরন হরমোন। তবে নারীদের ক্ষেত্রে মেনোপজ়ের প্রক্রিয়াটি যত দ্রুত ঘটে, পুরুষদের ক্ষেত্রে কিন্তু তা হয় না। এটি এতই ধীরে হয় যে পুরুষেরা সাধারণত তা অনুমানও করতে পারেন না।

Advertisement

স্ট্যাটিসটিক্স বলছে, পুরুষদের ক্ষেত্রে টেস্টোস্টেরনের স্তর সর্বাধিক থাকে ২০ বছর পর্যন্ত। এবং তার পর থেকে সেটি ধীরে ধীরে এক শতাংশ করে কমতে থাকে। জেনারেল ফিজ়িশিয়ান ডা. সুবীর মণ্ডলের মতে, যদি কোনও সমীক্ষা করা হয় তা হলে এই টেস্টোস্টেরন হ্রাসের হারের সূত্রে দেখা যাবে, মোট পঞ্চাশ বা তার অধিক বয়সের প্রায় অর্ধেক মানুষই ভুগছেন অ্যান্ড্রোপজ়ে। যদিও এই সময় যৌনক্রিয়ায় কিন্তু তাঁরা অনেকেই অপারগ হন না।

টেস্টোস্টেরনের গুরুত্ব

Advertisement

পুরুষদের শরীরে টেস্টোস্টেরন হরমোনের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ডা. মণ্ডল জানালেন, বডি স্ট্রাকচার মেনটেন করা থেকে শুরু করে যৌনকামনা— সবই হয় টেস্টোস্টেরনের কারণে। তা ছাড়া এই টেস্টোস্টেরনই পুরুষদের ক্ষেত্রে পুরুষোচিত চিন্তাভাবনার ক্ষমতা, মানসিক অবস্থা, পেশি বহুল দেহ গঠন বজায় রাখে। মানুষের গোঁফ, দাড়ি, চুল, রোম-ও কিন্তু গজায় এই টেস্টোস্টেরনের কারণেই।

লক্ষণ

অ্যান্ড্রোপজ়-এর লক্ষণগুলি এক এক জনের ক্ষেত্রে এক এক রকম হতে পারে। তবে সাধারণত মূল যে তিনটি লক্ষণ এ ক্ষেত্রে পাওয়া যায় সেগুলি হল— যৌনক্রিয়ার ইচ্ছা কমে যাওয়া, ইরেকটাইল ডিসফাংশন, মর্নিং ইরেকশন। ডা. মণ্ডলের মতে, টেস্টোস্টেরন হরমোন যেমন যৌনাঙ্গ দৃঢ় করতে সাহায্য করে তেমনই, এই প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে আরও একটি হরমোন, কর্টিসল। মানুষের শরীরে কর্টিসল নিঃসরণ হয় ভোরবেলা। ফলে সেই সময় অনেকের মর্নিং ইরেকশন হতে পারে। তা ছাড়া, টেস্টোস্টেরন কমে গেলে মানুষের স্বাভাবিক চিন্তাভাবনার ক্ষমতা ব্যাহত হয়, তিনি ডিমেনশিয়ায় ভুগতে পারেন। মানসিক স্থিতাবস্থা নষ্ট হওয়ায় আসতে পারে অবসাদ। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না। হতে পারে মুড সুইং-ও। এ ছাড়া, কম টেস্টোস্টেরনের কারণে যেহেতু মাসল মাস প্রভাবিত হয়, সে ক্ষেত্রে বডি ফ্যাট বেড়ে যায়, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ব্রেস্ট এনলার্জমেন্ট বা স্যাগিং হতে পারে। হার্টের পেশিও এর কারণে প্রভাবিত হওয়ায় দেখা দেয় হার্টের সমস্যা। গোঁফ, দাড়ি, চুল ও পিউবিক হেয়ারও কমে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। এই সব লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হওয়া উচিত বলে জানাচ্ছেন ডা. মণ্ডল।

পরীক্ষা

এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা প্রথমেই অ্যান্ড্রোপজ়ের মূল তিনটি লক্ষণ আছে কি না, তা জানতে চান রোগীর কাছে। পরিবর্তিত রক্ত চাপ, কিডনির সমস্যা, সিওপিডি, সুগার, থাইরয়েড-এর কারণেও হতে পারে। এ ছাড়া, বিটা-ব্লকার (পাল্স কমানোর ওষুধ) ওষুধ খেলেও হতে পারে ইরেকটাইল ডিসফাংশন। কিন্তু রোগীর যদি তেমন কোনও সমস্যা না থাকে, অথচ যৌনক্রিয়ার হ্রাস ও ইরেকটাইল ডিসফাংশন হচ্ছে তখন আসে অ্যান্ড্রোপজ়-এর প্রশ্ন। যাঁরা অতিরিক্ত মদ্যপান করেন তাঁদের যৌনকামনা থাকলেও যৌনক্রিয়ায় সমস্যা হয়। চিকিৎসকেরা প্রথমে এই বিষয়গুলি বিস্তারিত ভাবে জেনে নেন। তার পর আরও প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে জানা হয় অন্যান্য সমস্যাগুলির কথা। মৌখিক ডায়গনোসিস-এ কিছুটা আঁচ মিললে পরের ধাপে চিকিৎসকরা রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে রোগীর ফ্রি-টেস্টোস্টেরন এবং টোটাল টেস্টোস্টেরন লেভেল পরীক্ষা করেন। তাতে যদি ফল নেগেটিভ আসে এবং রোগীর মদ্যপান বা ক্রনিক কোনও সমস্যা না থাকে, তা হলে ধরে নেওয়া হয় সেই ব্যক্তির হাইপোগোনাডিজ়ম বা অ্যান্ড্রোপজ় হয়েছে।

এ ছাড়া অনেক সময়ে ইউএসজি করেও দেখে নেওয়া হয় ব্যক্তির টেস্টিস-এর ভলিউম ঠিক আছে কিনা। ডা. মণ্ডল জানাচ্ছেন, “আমাদের রক্তে দু’ধরনের প্রোটিন চলাফেরা করে বেড়ায়— একটি অ্যালবুমিন এবং অন্যটি গ্লোবিউলিন। এর মধ্যে কিছু কিছু অ্যালবুমিন এবং কিছু কিছু গ্লোবিউলিন সেক্স হরমোনগুলোকে আবদ্ধ করে রাখে। এদের বলে সেক্স বাইন্ডিং হরমোন। মনে রাখতে হবে, মানব শরীরে মাত্র ০.৫ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ হল অ্যাক্টিভ বা ফ্রি টেস্টোস্টেরন, যেগুলি কাজে লাগে। বাকি ৯৭ থেকে ৯৯ শতাংশ অ্যালবুমিন বা গ্লোবিউলিন বাউন্ড টেস্টোস্টেরন, যেগুলির শরীরে সরাসরি কোনও কাজ নেই। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীর কম টেস্টোস্টেরন উৎপাদন করে আর অন্য দিকে সেক্স হরমোন বাইন্ডিং গ্লোবিউলিন হরমোন, যেটা রক্ত থেকে ব্যবহারযোগ্য টেস্টোস্টেরন টেনে নেয়, তা বাড়তে থাকে।” ফলে পুরুষদেরও তাই বয়সের সঙ্গে যৌন কামনা কমতে শুরু করে এবং অ্যান্ড্রোপজ় প্রক্রিয়াটি শুরু হয়।

নিরাময়

মূলত লাইফস্টাইল পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকেরা। অর্থাৎ, যাঁরা অতিরিক্ত মদ্যপান করেন, তাঁদের মদ্যপান কমাতে হবে। যাঁরা স্থূলকায়, তাঁদের কমাতে হবে ওজন। তবে তার পরেও যদি সমস্যা থাকে, তবে তাঁকে ইঞ্জেকশন আকারে টেস্টোস্টেরন সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয়। এটা জেল বা প্যাচ আকারেও পাওয়া যায়। তবে এই ক্ষেত্রে প্রসটেট বা গোনাডাল ক্যান্সারের মতো রোগের কোনও ফ্যামিলি হিস্ট্রি রয়েছে কি না জেনে নিতে হয়। তা না হলে এই অবস্থায় রোগীকে সাপ্লিমেন্ট দিলে তাঁর ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কিন্তু এই সাপ্লিমেন্ট দেওয়ার পরেও তার যদি কোনও উন্নতি না হয়, সে ক্ষেত্রে এই সাপ্লিমেন্ট দেওয়া বন্ধ করে দিতে হয়। ডা. মণ্ডলের পরামর্শ, অ্যান্ড্রোপজ়ের উল্লিখিত লক্ষণগুলি দেখা দিলে বিলম্ব না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। তবেই এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement